যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় : স্বপ্নীল পথচলা
যশোর শহর থেকে উত্তর-পশ্চিমে ১৫ কিলোমিটার গেলেই আমবটতলার নিরিবিলি প্রান্তরে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসের চারপাশে সবুজের সমারোহ। ফসলের মাঠ। পাখি ডাকা সকাল থেকে পুরো প্রাঙ্গণ হয়ে ওঠে মুখর।
এমনই এক প্রাণবন্ত সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাডেমিক ভবনের পাশে দেখা হলো শিক্ষার্থীদের একটা দলের সঙ্গে। গাছের ছায়ায় বসে গল্প করছিলেন তাঁরা। অনুমতি নিয়ে তাঁদের আড্ডায় সঙ্গী হলাম। পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং (পিএমই) বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ফারহীন রুম্পা বললেন, ‘আমাদের এখানে নিয়মিত পাঠচক্র হয়। বইপড়া, গল্প, আড্ডার মধ্য দিয়ে আমরা নতুন কিছু ভাবতে শিখি।’ শিক্ষার্থীদের ভাবনায় যে নতুনত্ব আছে, প্রমাণ পাওয়া গেল চতুর্থ বর্ষের ছাত্র সীমান্ত কুমার পালের সঙ্গে কথা বলে। প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতি ও শুক্রবার তাঁরা বন্ধুরা মিলে বেরিয়ে পড়েন। চলে যান আশপাশের গ্রামগঞ্জ-বস্তিতে। তারপর? সীমান্ত বলছিলেন, ‘আমরা খুঁজে বেড়াই প্রতিবন্ধীদের। তাঁদের তালিকা তৈরি করি। তাঁদের সমস্যা শুনে সমাধানের পথ খুঁজি। দুই বছর ধরে আমরা এ কাজ করছি।’ একই বিভাগের শিমুল হোসেন ও রেহেনা আকতারও এ কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কী স্বপ্ন দেখায়? শিল্প ও উৎপাদন প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র মঈনুদ্দিন গাজী জানালেন উদ্যোক্তা হওয়ার কথা। অন্যদিকে রসায়ন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী রজনী আকতারের ইচ্ছা, বৃত্তি নিয়ে দেশের বাইরে পড়তে যাবেন। উচ্চশিক্ষা শেষে ফিরে এসে দেশের জন্য কিছু করবেন। বলছিলেন, ‘আমাদের বড় ভাইবোনদের অনেকে জার্মানিসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে ডিগ্রি নিচ্ছেন। তাঁদের দেখেই স্বপ্নটা প্রবল হয়েছে।’
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেল, ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে ছয়টি অনুষদের ১৯টি বিভাগে ৩ হাজার ৬৬৪ জন শিক্ষার্থী আছেন। প্রতিষ্ঠার ৮ বছরে ৪৩৬ জন স্নাতক শেষ করেছেন। স্নাতকদের মধ্যে বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ভিনদেশে পাড়ি জমিয়েছেন ২০ জন। বাকিরা অনেকেই কর্মজীবনে সফলতা পেতে শুরু করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবি, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে তাঁরাই প্রথম শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগ চালু করেছেন। বর্তমানে এ বিভাগে ষষ্ঠ ব্যাচের পাঠদান চলছে। ১৮০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে অন্তত ২৫ জন দেশের জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন খেলাধুলায় অংশ নিয়েছেন।
বাংলাদেশ মহিলা খোখো দলের অধিনায়ক ফাতেমা-তুজ-জোহরা ও বাংলাদেশ বাস্কেটবল দলের অধিনায়ক শামসুজ্জামান খান এ বিভাগে পড়ছেন। ফাতেমা-তুজ-জোহরার যমজ বোন জান্নাতুল ফেরদৌসও জাতীয় খোখো দলের খেলোয়াড়। তিনিও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। দুই বোনই জাতীয় অনূর্ধ্ব ১৯ মহিলা ফুটবল দলেও খেলছেন।
এই ক্যাম্পাসের ‘উসাইন বোল্ট’-দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র উজ্জ্বল চন্দ্র সূত্রধর। ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে জাতীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতা-২০১৫তে রেকর্ড গড়েছেন। জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে মোট পাঁচটি সোনা ও তিনটি রৌপ্য যোগ হয়েছে তাঁর ঝুলিতে। শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী মো. আল আমিনের অর্জনও অবাক করার মতো। তিনি জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ২০০৫ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত মোট ৩০টি সোনা, দুটি রৌপ্য ও ১৯টি ব্রোঞ্জের মালিক হয়েছেন। শেষ বর্ষের রিয়াদ হোসেন মুষ্ঠিযুদ্ধে (বক্সিং) ২০১৪ সালে বাংলাদেশ গেমসে রৌপ্য ও ২০১১ সালে সোনা জিতেছেন। জিমন্যাস্টিকস খেলায় প্রথম বর্ষের ফারজানা আক্তার জাতীয় পর্যায়ে সোনা ও ইসাদ হোসেন ইন্দো-বাংলা ও জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জ জিতেছেন। এ ছাড়া চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে সেকেন্ড সাউথ ইস্ট স্পোর্টস অ্যান্ড কালচারাল প্রোগ্রাম-২০১৬তে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ জনের ফুটবল দল অংশ নিয়েছিল। ১৮টি দেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত এ প্রতিযোগিতায় পঞ্চম স্থান অর্জন করে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবল দল।
তবে এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা প্রাপ্তির পাশাপাশি কিছু অপ্রাপ্তির কথাও বললেন। প্রয়োজনীয় মাঠ, জিমনেসিয়াম, উন্নত সুযোগ-সুবিধা থাকলে খেলাধুলায় তাঁরা আরও ভালো করতে পারবেন বলে বিশ্বাস করেন।
শিক্ষার্থীদের তৈরি ড্রোন
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্প ও উৎপাদন প্রকৌশল বিভাগের তৃতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থীরা কম খরচে ড্রোন তৈরি করেছেন। ২১ নভেম্বর দুপুরে যা ক্যাম্পাসের মাঠে সফলভাবে উড়িয়ে দেখিয়েছেন তাঁরা। বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সম্রাট কুমার দের তত্ত্বাবধানে আটজন শিক্ষার্থী মিলে প্রায় ছয় মাস গবেষণা করে ড্রোনটি তৈরি করেছেন। গবেষণা দলের শাহেক বিশ্বাস জানান, যন্ত্রটি বন্যাকবলিত অঞ্চলে জরুরি ওষুধসহ অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করতে পারবে। গবেষণা দলের অন্যান্য শিক্ষার্থীরা হলেন আবদুল্লাহ-আল-নাঈম, শাহজাহান আলী, বিধান কর, মো. আতাউর রহমান, মো. তাওহীদ হাসান, নাজমুল হাসান ও ফরহাদ হোসাইন।
ক্যাম্পাসে স্বতন্ত্র ইনস্টিটিউট
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গবেষণার কাজকে আরও এগিয়ে নিতে ক্যাম্পাসে স্থাপন করা হচ্ছে ড. ওয়াজেদ আলী মিয়া ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্স স্টাডিজ নামে একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠান যশোর শহরে উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা শেখ হাসিনা সফটওয়্যার পার্কের জন্য দক্ষ জনবল তৈরির কাজ করবে। একই সঙ্গে বাংলা ভাষার পাশাপাশি অন্যান্য ভাষা ও খাদ্যনিরাপত্তা বিষয়ে ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেট কোর্স চালু হওয়ার কথা আছে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের মানুষও জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পাবেন।
নেতৃত্ব গঠন, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিচ্ছি
ড. আবদুস সাত্তার
উপাচার্য, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে সহায়ক সব ধরনের কোর্স ও কারিকুলাম হাতে নেওয়া হয়েছে। দক্ষ নেতৃত্ব উন্নয়নে আমরা ক্রীড়া ও সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিচ্ছি। এ জন্য ক্যাম্পাসে একটি ক্রীড়া কমপ্লেক্স স্থাপনের স্বপ্ন রয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় জায়গার অভাবে সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। এখানে একটি স্টেডিয়াম করা হলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেত।