মানুষের জন্য কাজ করতে চাই : ফারজানা ইয়াছমিন
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
আমার শৈশব কাটে নওগাঁ জেলার রানীনগর উপজেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম রাতোয়ালে। আমাদের মধ্যবিত্ত আয়ের পরিবার। বাবার প্রধান আয়ের উৎস কৃষিকাজ এবং মা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। চার বোনের মধ্যে আমিই বড়। পরিবারের বড় মেয়ে হওয়ায় সবার আদর একটু বেশি পেয়েছি। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত আমি গ্রামের বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি। প্রতিটি শ্রেণীতে প্রথম এবং পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পাওয়ার পর আমাকে নিয়ে বাবা-মার স্বপ্ন বিস্তৃত হয়। আমাকে পাঠিয়ে দেন মামার কাছে নওগাঁ শহরে। ভর্তি পরীক্ষায় মেধাক্রমে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই নওগাঁ সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে। এরপর বাবা-মা আমার আরও ভালো লেখাপড়ার পরিবেশের জন্য সপরিবারে বগুড়ায় চলে আসেন। শুধু মেয়েদের পড়াশোনার জন্য এত কিছু করা আমাদের গ্রামের অনেকেই ভালোভাবে মেনে নেয়নি। কিন্তু আমার বাবা-মা সবসময় বলেন, সন্তানদের মধ্যে কেন ভেদাভেদ থাকবে? মেয়েসন্তান বলে কি তারা পিছিয়ে থাকবে? আমার মা নিজেও চাকরিজীবী বলে অনেকের উপেক্ষা সহ্য করতে হয়েছে। আমাদের দেশে, বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজে এখনও এই ভেদাভেদের দেয়াল আছে বলে উন্নত বিশ্ব থেকে আমরা পিছিয়ে আছি। যদি আমাদের সমাজ তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে তবে মেয়েরাও দেশের সব ধরনের উন্নয়নে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হই বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড স্কুলে এবং অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হই বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজে। আমি ছোটবেলা থেকেই বাবা-মায়ের শাসন খুব ভয় পেতাম বলে তাদের বাধ্যগত ছিলাম। গ্রামের স্কুলের তুলনায় শহুরে স্কুলগুলোতে প্রতিযোগিতা বেশি বলে মা সবসময় পড়াশোনার কথা বলতেন। কিন্তু বাবা কিছুটা স্বাধীনচেতা বলে আমাদের পড়াশোনার ব্যাপারে স্বাধীনতা দেওয়ার চেষ্টা করতেন। বাবাই আমাদের গণিত বিষয়ের জন্য প্রধান গুরু। তিনি আমাদের ছবি আঁকানো শিখিয়েছেন। আমার গৃহশিক্ষকরাও সবসময় পড়াশোনার ব্যাপারে অনুপ্রেরণা জোগাতেন। আমি বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ থেকে এসএসসিতে এ+ এবং এইচএসসিতে গোল্ডেন এ+ পাই। এরপর আমি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি প্রকৌশল ও কারিগরি অনুষদের অধীনে বিএসসি. ফুড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হই। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন পরিবেশে বড় আপু, সহপাঠী এমনকি হলের বুবুরা সবসময় আমাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। আমার বাবা-মা সবসময় পড়াশোনার যত্ন নিতেন এবং এখনও মুঠোফোনে খোঁজখবর রাখেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাস করতাম এবং স্যারদের লেকচার খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম আর সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো লিখে রাখতাম। ফলে পরীক্ষার আগে খুব বেশি পরিশ্রম করতে হতো না। আমি অনার্স ফাইনাল পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় হই। এছাড়া অনার্স তৃতীয় বর্ষের সর্বোচ্চ ফলের জন্য প্রফেসর এসএম নাজমুল হক স্মৃতি ট্রাস্ট বৃত্তি লাভ করি। বর্তমানে ফুড টেকনোলজি ও গ্রামীণ শিল্প বিভাগের অধীনে ফুড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স করছি। এরপর ইচ্ছা আছে উচ্চতর ডিগ্রি লাভের জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার।
আমার বাবা-মা আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক। প্রতিনিয়তই তাদের কাছ থেকে কিছু না কিছু শিখছি। আমাদের জন্য মা কখনও বাবার ভূমিকা আবার বাবা কখনও মায়ের ভূমিকা পালন করেছেন। বাবা-মার এই আত্মত্যাগ নিঃসন্দেহে যে কোনো সন্তানের জীবনযুদ্ধের পাথেয় হিসেবে যথেষ্ট।
বর্তমান বিশ্বে খাদ্য নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। একজন খাদ্য প্রকৌশলী হিসেবে আমি আমার দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকরণের জন্য গবেষণামূলক কাজ করতে চাই এবং আমার অর্জিত জ্ঞান সবার মাঝে বিলিয়ে দিতে চাই।
স্নাতকে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয়, ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং, ফুড টেকনোলজি ও গ্রামীণ শিল্প বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ