ই-কমার্স বদলে দেবে আগামী দিনের অর্থনীতি

ই-কমার্স বদলে দেবে আগামী দিনের অর্থনীতি

  • রেজাউল করিম খোকন

ই-কমার্স এখন অতি পরিচিত একটি শব্দ। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম এবং শিক্ষিত শ্রেণির মানুষের মধ্যে ই-কমার্সের প্রচলন বেশি। আজকাল স্বল্পশিক্ষিত মানুষজনদের মধ্যেও এই ই-কমার্স অপরিচিত বা অজানা বিষয় নয়। দিনে দিনে ই-কমার্স বেশ প্রচলিত এবং জনপ্রিয় বিষয় হয়ে উঠেছে অর্থনীতি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে। পণ্যের সহজপ্রাপ্যতা ও সহজলভ্যতা মানুষের মধ্যে ভোগ প্রবণতা বৃদ্ধি করে। আর এ দুটি কাজেই সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে ই-কমার্স। বাণিজ্যিক আমদানিকারক থেকে শুরু করে ভ্রমণকারীর পণ্যও এখন অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে। কেউবা বিশাল পরিসরে নিজস্ব অনলাইন পোর্টালে বিক্রি করছে। আবার কেউ কেউ বেছে নিয়েছে ফেসবুক বা অন্য কোনো সামাজিক মাধ্যমকে। ই-কমার্সে বিক্রেতা ও ক্রেতার সংখ্যা হু হু করে বেড়ে চলেছে। যার প্রেক্ষিতে বাজারে তৈরি হয়েছে প্রতিযোগিতা। যার ফলে প্রতিযোগিতামূলক মূল্যেই ক্রেতারা পণ্য কেনার সুযোগ পাচ্ছে। এভাবে বাড়ছে ভোগের পরিমাণও। পণ্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী চাহিদা বৃহদায়তন উত্পাদন ও আমদানির পথকে সুগম করছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে ব্যবসার পরিধি। তৈরি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ। সবকিছু মিলিয়ে অর্থনীতিতে বয়ে আনছে ইতিবাচক গতি। তাই ই-কমার্সই বদলে দিতে পারে আমাদের আগামী দিনের অর্থনীতি। এখন অনেকেই ই-কমার্সেই আমাদের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির সম্ভাবনা খোঁজার চেষ্টা করছেন।

উন্নত বিশ্বে প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটেছে অপ্রতিহত গতিতে। ফলে সেখানকার অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্য হয়ে পড়েছে প্রযুক্তি নির্ভর। এমন কি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও নগদ টাকার পরিবর্তে ব্যবহার করা হচ্ছে মোবাইল ওয়ালেট। আমাদের এখানেও নগদ টাকার পরিবর্তে বিভিন্ন ধরনের কার্ড, বিকাশ, রকেট, শিওর ক্যাশ প্রভৃতির মধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং এর ব্যবহার দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। ওয়েব ভিত্তিক অর্থনীতি বিশ্বে এখন বেশ শক্তিশালী হচ্ছে। ই-কমার্স এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। এখন কেনাকাটা আর্থিক লেনদেন প্রভৃতিতে ওয়েবের ব্যবহার বিলাসিতার পর্যায়ে নেই। বিশ্বের বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণ মানুষের চাহিদার কথা বিবেচনা করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এভাবে ওয়েবভিত্তিক অর্থনীতির পরিধি বেড়েই চলেছে। ওয়েবভিত্তিক অর্থনীতি বড় হওয়ার মূল কারণ মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহারের আধিক্য। দুই বছর আগেই ওয়েবভিত্তিক অর্থনীতির পরিমাণ ছিল প্রায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার। আর ২০১৬ সাল শেষে তা ৪ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে বলে জানা যায় বিভিন্ন সূত্রে।

সর্বোপরি কর্মময় মানুষের ব্যস্ততা, রাস্তাঘাটের যানজট, তাত্ক্ষণিক প্রয়োজন মেটানো ইত্যাদি কারণেও মানুষ ক্রমশ অনলাইনে কেনাকাটা করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এ কারণেও আমাদের দেশে ই-কমার্সের সম্ভাবনা অনেক বেশি। এখানে ই-কমার্সের আওতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের দেশে এখন যে পরিসরে আর্থিক কর্মকাণ্ড, ব্যবসা-বাণিজ্য ই-কমার্সে হচ্ছে তার পরিধিও বৃদ্ধি পাবে। শুধু একক ক্রেতা নয়, প্রতিষ্ঠান পর্যয়ের কেনাকাটাও ই-কমার্সের আওতায় চলে আসবে। ইতিমধ্যে অনেকেই এই ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। বিদেশের আমাজন, আলিবাবা ডট কম এর মত বাংলাদেশে চাল ডাল ডট কম, বিক্রয় ডট কম, বাগডুম ডট কম, সহজ ডট কম এর মত জনপ্রিয় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসার পরিধি ক্রমেই বিস্তৃত করছে। অনেকেই ফেসবুকের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করছে। ই-কমার্সে শুরুতে নানাজনের সন্দেহ, অবিশ্বাস, সংশয় ছিল। সেই সংশয় দূর হয়ে এখন মানুষের আস্থা অনেক বেড়েছে ই-কমার্সে। যারা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কিনে একবার দু’বার সন্তুষ্ট হতে পেরেছেন তারা এখন আরো দামি পণ্যসামগ্রী কিনতেও দ্বিধা করছেন না। বাসায় বসেই টিভি কিনছেন, মোবাইল সেট, ফ্রিজ, দামি পোশাক, জুয়েলারী কিনছেন। এ সবই ই-কমার্সের জন্য ইতিবাচক দিক। সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও অসংখ্য তরুণ-তরুণী ফেসবুকের মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রি করছে। অসংখ্য ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তাদের পণ্য বিক্রি করছে এই মাধ্যমে। ফেসবুকের মাধ্যমে কেউ কেউ ঘরে বসে নিজের তৈরি পণ্যের খবর জানিয়ে দিচ্ছে দেশ-বিদেশে। বিক্রি করছে ক্রেতাদের কাছে। এ ক্ষেত্রে বিক্রির তালিকায় বিচিত্র পণ্য দেখা যাচ্ছে। পাখির খাবার থেকে শুরু করে জন্মদিনের কেক, পোশাক, পিঠাপুলি, নকশিকাঁথা, মোবাইল ফোন সেট সবই থাকছে পণ্য তালিকায়। এই ফেসবুকের কল্যাণে কারো কারো আয়ের পরিমাণ মাসে লাখ টাকাও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ঘরে বসে লাখ টাকা আয়ের এই সুযোগ সম্ভব হয়েছে মূলত ই-কমার্সের কারণেই। একজনকে দেখে আরেকজন উত্সাহিত হচ্ছে। আর প্রতিনিয়ত বাড়ছে ফেসবুকে নতুন নতুন উদ্যোক্তার সংখ্যা। ফেসবুকের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি শুরু করলেও অনেকের মনে রয়েছে আগামী দিনের বড় স্বপ্ন। তারা বুঝতে পারছে আগামী দিনে ই-কমার্সই হবে দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি। যে কোনো ধরনের পরিবর্তনকে মানুষ খুব সহজে গ্রহণ করতে পারে না। ই-কমার্সের ধারণার সাথে দুটি পরিবর্তনকে গ্রহণ করতে হয়েছে। এর একটি প্রযুক্তির পরিবর্তন, আরেকটি কেনাকাটার ধরনে পরিবর্তন। ই-কমার্সে একদল তরুণ ব্যবসা করছে এমন কিছু আইটেম যা আগে কখনও কেউ ভাবতে পারেনি। পাখির খাবার, পাখি, অ্যাকুরিয়ামের মাছ, মাছের খাবার, খরগোস থেকে শুরু করে অনেক অপ্রচলিত পণ্যই এখন ই-কমার্সের বদৌলতে অহরহ বিক্রি হচ্ছে। অজপাড়া গাঁয়ের তৈরি একটি পণ্যও এখন কোনো না কোনো উদ্যোক্তার হাত ঘুরে চলে যাচ্ছে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। যে পণ্য সম্পর্কে মানুষ জানতো না সেই পণ্য সম্পর্কে জানার সুযোগ পাচ্ছে। যে পণ্যের প্রতি আগ্রহ থাকার পরও কেনার সুযোগ পায়নি এখন সেই পণ্য কেনার সুযোগ হচ্ছে। অনলাইনে বিক্রি হওয়া পণ্যের মূল্য কম হওয়ার আরেকটি প্রধান কারণ হলো, এ ক্ষেত্রে ব্যবসা করার জন্য বড় কোনো শপিং মলে বিশাল অংকের জামানত দিয়ে দোকান নিতে হচ্ছে না। প্রতিমাসে বিপুল পরিমাণ দোকান ভাড়া, সার্ভিস চার্জ, বিদ্যুৎ খরচ বাবদ বড় অংকের টাকা খরচ হচ্ছে না। এক সাথে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে পণ্য কিনে দোকান সাজাতে হচ্ছে না। ফলে তুলনামূলকভাবে কম দামে তাদের পক্ষে পণ্য বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে।

আমাদের দেশে এমন অনেক পণ্য রয়েছে যেগুলোর প্রতি মানুষের প্রতি আগ্রহ থাকার পরও হাতের কাছে পাওয়া যায় না বলে কিনতে পারে না। ই-কমার্সই সেই প্রতিবন্ধকতা দূর করে মানুষকে সহজেই পণ্য ভোগে সহায়তা করতে পারে। এখন এদেশের অনেক পণ্যই পৃথিবীর নানা দেশের রপ্তানি হচ্ছে। অনেক পণ্যের বিপুল চাহিদাও রয়েছে। তৈরি পোশাক, জুতা, সিরামিক, হস্তশিল্প, চামড়াজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইলের পণ্যসহ আরও অনেক পণ্যই ই-কমার্সের মাধমে দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশের বাজারে বিক্রি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এ দেশেও গড়ে উঠতে পারে আমাজন বা আলিবাবা ডটকমের মতো বিশ্ববিখ্যাত কোনো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান।

সূত্র: ইত্তেফাকfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment