প্রাইভেট ও কোচিং বাণিজ্য আর নয়

প্রাইভেট ও কোচিং বাণিজ্য আর নয়

  • মেনহাজুল ইসলাম তারেক

গত ৬ জুলাই দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি জাতীয় দৈনিকের প্রধান শিরোনাম ছিলো: ‘কোচিং বাণিজ্যের বিরুদ্ধে দুদকের অভিযান শুরু’। এটিকে স্বাগত জানিয়ে আমি বলতে চাই, কোচিং বাণিজ্যের কাছে যেভাবে জিম্মি হয়ে পড়েছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা, তা খুবই উদ্বেগের বিষয়। দেশব্যাপী বিভিন্ন অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এ সংক্রান্ত ভয়াবহ এক চিত্র। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, স্কুল-কলেজে কোনোরকম হাজিরা দিয়েই শিক্ষার্থীদের ছুটতে হয় কোচিং সেন্টারে। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে বলা যায়, বর্তমানে স্কুল-কলেজের বদলে কোচিং সেন্টারগুলোই হয়ে উঠেছে মূল ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’! সবচেয়ে চিন্তার বিষয়, শিক্ষকদের একটি বড় অংশ জড়িয়ে পড়েছে এ ব্যবসায়। এতে লাভ বেশি, তাই তারা ক্লাসে শিক্ষা প্রদানে মনোযোগী নন। তারা নানা অজুহাতে, নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের তাদের কাছে প্রাইভেটে বা কোচিংয়ে পড়তে বাধ্য করছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই ভেঙে পড়বে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। কারণ এর ফলে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বাড়ছে। অপরদিকে মান কমছে শিক্ষার। কোচিং নির্ভরতার কারণে শিক্ষার্থীদের সৃজনী ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

 কোচিংয়ের আড়ালে নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডও চলছে। কোচিংয়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে রয়েছে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অসংখ্য অভিযোগ। কোচিং সেন্টার পরিচালনাকারীদের বিরুদ্ধে প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগ বেশ জোরালো। অনেক কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে উগ্র রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারেরও অভিযোগ আছে। অন্যদিকে কোচিংয়ের কারণে অভিভাবকদের আর্থিক ব্যয় বেড়ে গেছে। কিছুদিন আগে খোদ শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, কোচিং খাতে বার্ষিক লেনদেন প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এ লেনদেনের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকার কম নয়। বস্তুত কোচিং ব্যবস্থাটিই অনৈতিক। ‘এটি মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থাকে একেবারে প্রতিবন্ধী করে ফেলেছে। কাজেই এর বিরুদ্ধে আমাদের নামতেই হবে।’ প্রশ্ন হলো, এ ব্যাপারে সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? প্রায় পাঁচ বছর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোচিং বাণিজ্য বন্ধে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছিল। এ নীতিমালা অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি নিম্ন-মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসার কোনো শিক্ষক তার নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে বা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। নীতিমালা লংঘনের ক্ষেত্রে পাঁচ ধরনের শাস্তির কথা বলা ছিলো। তবে এ নীতিমালায় বাণিজ্যিক কোচিং বন্ধের কোনো উল্লেখ নেই। এর সুযোগ নিয়ে অবাধে চালানো হচ্ছে কোচিং বাণিজ্য। আমি মনে করি, নীতিমালার এ ফাঁকটি অবিলম্বে বন্ধ করে কোচিং বাণিজ্য কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। তবে শুধু আইন বা নীতিমালা সংশোধন করে এটি বন্ধ করা যাবে না। প্রয়োজন সরকারের সদিচ্ছা। কারণ কোচিং বাণিজ্যে জড়িতরা একটি বড় ও শক্তিশালী চক্র। রাজনৈতিক নেতাসহ প্রভাবশালী মহলের ছত্রচ্ছায়ায় চলে এ ব্যবসা। এ অবস্থায় একমাত্র সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কঠোর মনোভাবেই নির্মূল হতে পারে কোচিং বাণিজ্য। সেইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে নিরুত্সাহিত করার পদক্ষেপও নিতে হবে।

উল্লেখ্য, পিইসি, জেএসসি, সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি, ভর্তি পরীক্ষা ইত্যাদি কোচিং বাণিজ্যকে উত্সাহিত করছে। এর পাশাপাশি বলব, স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা যাতে কোচিংয়ের দিকে ঝুঁকে না পড়েন এ লক্ষ্যে তাদের জন্য পর্যাপ্ত বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করা হোক। মোদ্দাকথা, শিক্ষকদের ক্লাসে শিক্ষাদানে আন্তরিক হতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনোরকম ফাঁকিবাজি বা গাফিলতি বরদাশত করা চলবে না। কোচিং ও প্রাইভেটের কারণে স্কুলবিমুখ হওয়ার মানসিকতা পরবর্তী সময়ে উচ্চমাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা পর্যায়েও ছাত্র-ছাত্রীদের মনে বদ্ধমূল থাকে। আর এ কারণেই উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা পর্যায়েও ক্লাসে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার দিন-দিন বাড়ছে। শহরাঞ্চলের কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যতীত গ্রামের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি হতাশাজনক। প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকরা যদি শিশুদের প্রাইভেট কিংবা কোচিং করানো বন্ধ করেন এবং শতভাগ শিশুকে স্কুলমুখী করতে যত্নবান হন, তবে পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্কুলমুখী হওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি হবে। প্রাইভেট বা কোচিংমুখী হওয়ার প্রবণতাও কমে আসবে। জ্ঞান বিতরণের কাজটি এখন পরিণত হয়েছে বাণিজ্যের প্রধান উপকরণে। কাজেই মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিবোধের উন্নয়ন না ঘটিয়ে শুধু আইন প্রণয়ন করে যে অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়, তা আমরা নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছি।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এ পর্যন্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, গবেষণা ও কথাবার্তা কম হয়নি। কিন্তু সদিচ্ছার অভাব, নৈতিকতার অভাব, অব্যবস্থাপনা, অদূরদর্শিতা ও দুর্নীতির ঘূর্ণাবর্তে এর অধিকাংশই হারিয়ে গেছে। প্রাইভেট ও কোচিং বন্ধসহ বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে আমাদের আন্তরিকতা ও সততার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। সর্বোপরি রাষ্ট্রীয়ভাবে কোচিং ও প্রাইভেট সেন্টারগুলোর ব্যাপারে সার্বক্ষণিক তদারকিও প্রয়োজন।

লেখক : শিক্ষার্থী, এম.এস.এস (রাষ্ট্রবিজ্ঞান), কারমাইকেল কলেজ, রংপুর

সূত্র: ইত্তেফাকfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment