‘ঢাবি’ লইয়া আমরা কী করিব ?

‘ঢাবি’ লইয়া আমরা কী করিব ?

  • মনিরুল ইসলাম মনি

মাত্রাতিরিক্ত সেশনজট নিরসনসহ বেশ কয়েকটি সমস্যা সমাধানে রাজধানীর সাত সরকারি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধীনে অধিভুক্ত করা হয় চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি। আগে এই কলেজগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই ছিল। তারও আগে এই কলেজগুলো ঢাবির অধীনেই ছিলো। এই খবর শুনে তো আমরা স্বপ্নের আকাশে ভাসছিলাম। কল্পনার জগত্টাও কেমন যেন রঙিন হয়ে গিয়েছিল। তবে স্বপ্নের আকাশে না যত উড়েছিলাম ঠিক তারও একশ’ গুণ বেশি বেগে ছিটকে পড়েছি অন্ধকারে। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ছয় মাসের মধ্যেও এখন পর্যন্ত ছিটেফোঁটা কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি। মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছিলাম গতবছর। আমাদের বন্ধুরা যারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ভর্তি হয়েছিল ইতোমধ্যেই তারা পরীক্ষার সময়সূচি পেয়ে গেছে। এ যন্ত্রণা শুধু আমার একার নয়; এ তালিকায় আছে আরও দুই লাখ ৪০ হাজার শিক্ষার্থী। এখন পর্যন্ত আমরা কী পড়বো সে সম্পর্কে কোনো সিলেবাস বা দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়নি। তাই আপাতত গল্পের বই পড়ে সময় কাটাচ্ছি। আর পত্রিকায় এই সাত কলেজের কোনো সংবাদ থাকলে মনোযোগ সহকারে তা পাঠ করছি। একবছর পরের দৃশ্যই যদি এমন হয় তাহলে ক্যামনে কী!

হ্যাঁ ঢাবি শুধু একটি কাজ করেছে! সেটি হলো আমাদের এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতকের নিবন্ধন ও প্রবেশপত্র, নম্বরপত্র এবং সম্প্রতি তোলা ছবি নিয়েছে। আমাদের সকল তথ্য সরিয়ে ফেলেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে। অপেক্ষার প্রহর নাকি শেষ হতে চায় না! কথাটি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি এই পর্যায়ে এসে। দিন যতই যাচ্ছে ততই উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা জেঁকে বসছে। চরম এক হতাশা আর অনিশ্চয়তায় গত হচ্ছে আমাদের প্রতিটি ক্ষণ।

এ তো বললাম আমাদের হতাশার গল্প। এবার সামগ্রিকভাবে কিছু অসঙ্গতি তুলে ধরছি। ২০১৫ সালে অনার্স পরীক্ষার্থীদের ফলাফল প্রকাশ হলেও এই ফলের স্বাদ থেকে বঞ্চিত ঢাবি’র সদ্য অধীন সাত কলেজের অধমরা। তাদেরও দেওয়া হয়নি কোনো সিলেবাস। আগের পাঠ্য আর সিলেবাস অনুযায়ী পড়তে হচ্ছে তাদের। এই কলেজগুলোতে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজারের মতো। তাহলে তারা কি সেশনজটের মধ্যে পড়ছে না? ব্যাপারটি কি ‘শিব গড়তে বাঁদর গড়া’র মত হয়ে গেল না?

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৫ সালের স্নাতক (সম্মান) চতুর্থ বর্ষের লিখিত পরীক্ষা শুরু হয়েছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনেই, ৩ জানুয়ারি। শেষ হয় গত ১১ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু ব্যবহারিক শুরু হওয়ার আগেই ঢাবি’র অধীনে চলে যায় কলেজগুলো। যদিও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় থাকা অন্য কলেজগুলোর ব্যবহারিক পরীক্ষা শেষ করে ফলাফলও ইতোমধ্যেই দেওয়া হয়েছে। রেজিস্ট্রেশনের প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকায় এই কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের মৌখিক ও ব্যবহারিক পরীক্ষাও নেওয়া হয়নি। তবে ঢাবি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা বা গড়িমসি যাই বলি না কেন, তারা কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে হেরে গেছে। ঠিক খরগোশ আর কচ্ছপের গল্পের মতো! কেননা ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের নিয়মিত ও প্রাইভেট (নতুন সিলেবাস) এমএ, এমএসএস, এমবিএ, এমএসসি ও এমমিউজ শেষপর্ব পরীক্ষা শেষ করছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৬ সালের ডিগ্রি (পাস) ও সার্টিফিকেট কোর্স পরীক্ষা গত ১৬ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে। অথচ ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা পুরোপুরি অন্ধকারে রয়েছে। তারা এ পরীক্ষায়ও অংশ নিতে পারছে না। নিয়ম আছে ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার আগের ইয়ারে অনুত্তীর্ণ বিষয়গুলোতে উত্তীর্ণ না হলে ফল স্থগিত থাকে। এখন এ ধরনের শিক্ষার্থী, যারা একাধিক বর্ষে বিভিন্ন বিষয়ে অনুত্তীর্ণ হয়েছে, তারা কোন্ সিলেবাসে, কোথায়ই-বা পরীক্ষা দিবে তা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় রয়ে গেছে। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে নাকি খুব তাড়াতাড়ি এসব শিক্ষার্থীর সমস্যা সমাধানও সম্ভব না বলেও সংশয় রয়েছে।

সমস্যা যখন এতো এতো, তাহলে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার দরকার ছিল কী? সমস্যাগুলো চিহ্নিত না করেই হুট করেই কেন এরকম ঘোষণা! যখন ঘোষণা আসলো তখন থেকেই ঢাবি’র শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন; আন্দোলনে মাঠেও নেমেছিলেন। এরপর থেকে ঢাবি কর্তৃপক্ষের কেমন যেন একটা উদাসীনতা ও বিমাতাসুলভ ভাব আমাদের প্রতি। আন্দোলনের পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় ভিসি আ আ ম স আরেফীন সিদ্দিকী স্যার উচ্চমান আর নিম্নমানের পার্থক্যটা বেশ ভালোভাবেই বুঝিয়েছিলেন। ঢাবি’র অধীনে যাওয়া ঢাকার স্বনামধন্য সাতটি কলেজ হলো—ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। তাতে লাভও নেই আবার ক্ষতিও নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ই হোক আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই হোক, যদি শিক্ষার কার্যক্রম নিয়ম অনুযায়ী চলে তাহলে সমস্যা কোথায়? বিশ্ববিদ্যালয় নয় আমাদের দরকার সময়োপযোগী সুস্থ একটি শিক্ষা ধারা। যেখানে সময়মতো সবকিছু পরিচালিত হবে। বারবার আইন প্রণয়ন করে শিক্ষার মেরুদণ্ডকে দুর্বল করা হচ্ছে, ভুক্তভোগী হয় আমাদের মতো জোয়ালের লাঙ্গলেরা। যেদিক টানছে সেদিকেই যাচ্ছি। ঢাবি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে যে আমরা পরাধীন সেটা খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছি এতদিনে।

দেশের স্বার্থে শিক্ষার মান নিয়ে শিক্ষা গবেষক ও বিশ্লেষকরা যদি আর একটু মনোযোগ দিতেন তাহলে এই সমস্যাগুলো সৃষ্টি হতো না। শুধু অধীনে নিলেই তো হবে না। তাদেরকে একটু যত্ন-আত্তিও দিতে হয় আপন ছেলের মতো। তাহলে মানবৃদ্ধির চিন্তা নিয়ে এমন একটি সিদ্ধান্ত অবশ্যই সফল হবে, হতে বাধ্য।

নইলে তো বলবোই- ‘ঢাবি’ লইয়া আমরা কী করিব?

লেখক : শিক্ষার্থী, সরকারি বাংলা কলেজ, ঢাকা

সূত্র: ইত্তেফাকfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment