‘শিক্ষার্থী থাকতেই ক্যারিয়ার শুরু করেছিলাম’

‘শিক্ষার্থী থাকতেই ক্যারিয়ার শুরু করেছিলাম’

  • শলমো মাইতাল

গবেষণা ও উন্নয়ন সেন্টার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসরায়েল সাত হাজারের অধিক স্টার্টআপ ও সাড়ে তিন শোর মতো বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান চালু করেছে। সবগুলো প্রতিষ্ঠানই মুনাফা দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে। ইসরায়েলের মানুষদের এই অসাধারণ সৃজনশীল ক্ষমতা রয়েছে। তারা বেশ ভালো করেই জানে, যেকোনো স্টার্টআপের অক্সিজেন হচ্ছে ‘মুনাফা’।

কিন্তু একই সময়ে ইসরায়েলে প্রচুর সামাজিক সমস্যাও রয়েছে। ইসরায়েলে এখন পর্যাপ্ত বিনিয়োগকারী কিংবা সাহায্য করার মতো সংস্থা নেই। ঘাটতি রয়েছে সরকারি বাজেটেরও। সৃজনশীল আইডিয়ার মাধ্যমে এই সমস্যাগুলো মোকাবেলা করা ছাড়া উপায় নেই। ইসরাইলের হাসপাতালগুলোতে এখন উপচেপড়া ভীড়, স্কুলগুলোর তেমন উল্লেখযোগ্য অর্জন নেই, জাতীয় বীমা ব্যবস্থা ও পেনশন ব্যবস্থা দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে, ধনীরা কর ফাঁকি দিতে দিতে কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে—মোটা দাগে বলতে গেলে এগুলিই ইসরায়েলের এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ছাড়া সামাজিক পরিবর্তনগুলোতে উদ্যোক্তাদের খুব একটা দেখা যায় না। ইসরায়েলের এখন এমন একটি পরিবর্তনকামী বাহিনী দরকার যারা এই সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করবে। পাশাপাশি তারা প্রযুক্তিগত গেজেট তৈরি করে এমন স্টার্টআপগুলোও কার্যকর করবে।

ইসরায়েল থেকে বেশ দূরে আমি এর একটা সম্ভাব্য সমাধান খুঁজে পেয়েছিলাম। সেটা মেক্সিকোর মনটেরি শহরের টেকনোলজিকো দা মনটেরিতে। সেখানে উদ্যোক্তাবৃত্তি বিষয়ক একটি সম্মেলনে আমি কথা বলেছিলাম। সেই সম্মেলনে এমিলি ল্যাম্ব নামের এক চমৎকার নারীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। এমিলি ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক সামাজিক উদ্যোক্তাবৃক্তিক সংস্থা অশোকার জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক। তাঁর সঙ্গে একটি প্যানেল আলোচনায় অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। এমিলি আমাকে বলেছিলেন, মানুষের ভেতরের পরিবর্তনকামী সত্তাকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করাই অশোকার কাজ।

অশোকা একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। সংস্থাটি এমন কিছু সামাজিক উদ্যোগনির্ভর প্রকল্প নিয়ে কাজ করে, যে প্রকল্পগুলো সমাজে পরিবর্তন আনে। আর পরিবর্তনগুলো মানুষের কল্যাণ সাধন করে। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে: একটি দক্ষ উদ্যোক্তা মানসিকতার নাগরিক দিয়ে পৃথিবীকে গড়ে তোলা।

আজ থেকে ৩৯ বছর আগে ম্যাকিনসে অ্যান্ড কোম্পানির সাবেক পরামর্শক বিল ড্রেটন অশোকা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মাথা থেকেই প্রথম বের হয়েছিল সামাজিক উদ্যোগের ধারনা। ১৯৭২ সালে এক সাক্ষাৎকারে বিল ড্রেটন বলেন, ‘কাউকে মাছ ধরতে শেখানো কিংবা কীভাবে আরেকজনকে মাছ ধরে দিতে হয় সেটা শেখানোই সামাজিক উদ্যোগের প্রকৃত বিষয় নয়। বরং মাছ ধরা শিল্পে বিপ্লব না আসা পর্যন্ত সামাজিক উদ্যোক্তারা থামবে না—এটিই সামাজিক উদ্যোগের মূল প্রতিপাদ্য।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, অশোকা ইতিমধ্যেই সারা বিশ্বে এক গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে।

সামাজিক পরিবর্তনের সমস্যা সমাধানকারী উদ্যোক্তাদের খুঁজে বের করে অশোকা। অশোকা এমন উদ্যাক্তাদেরই খোঁজে যারা সমাজে বড় রকমের পরিবর্তন আনতে চায়, যে পরিবর্তন ব্যক্তি মানুষের চেয়ে বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর জন্য উপকার বয়ে আনবে। অশোকা যেসব সামাজিক উদ্যোক্তাদের বেছে নেয়, তাদেরকে বলা হয় ‘অশোকা ফেলো’। ফেলোদেরকে একটি মোটা অঙ্কের আর্থিক বৃত্তি দেয়া হয়, যাতে তারা নির্ভাবনায় সম্পূর্ণ সময় সমস্যা সমাধানের আইডিয়া উদ্ভাবনে ব্যয় করতে পারে। এই বৃত্তি তিন বছর পর্যন্ত দেয়া হয়। অশোকা এই অর্থ সংগ্রহ করে সরকারি এবং বেসরকারি দাতা সংস্থাদের কাছ থেকে।

এমিলি ল্যাম্বের সঙ্গে কথপোকথনের কিছু অংশ:

নিজের সম্পর্কে কিছু বলুন, এমিলি? কীভাবে অশোকায় আপনার যাত্রা শুরু হয়েছিল? প্রথম কবে যোগ দিয়েছিলেন অশোকায়, মনে আছে?

আমি যখন ইউনিভার্সিটি অব কানসাসের শিক্ষার্থী ছিলাম তখন সেখানকার কমিউনিটি আউটরিচ সেন্টারের ‘স্টুডেন্ট ডিরেক্টর’ হয়েছিলাম। বলতে পারেন সেটাই আমার ক্যারিয়ারের শুরু। একজন স্টুডেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে আমাকে তখন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হতো। তাদেরকে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে অন্তর্ভুক্ত করতে হতো। ওই দুই বছরে আমি গভীরভাবে চিন্তা করতে শিখেছি। কীভাবে সমস্যা সমাধান করতে হয়, তা শিখেছি। কীভাবে সবকিছুকে সমন্বয় করতে হয় তা শিখেছি। সর্বাপরি, কীভাবে লক্ষ্য অর্জন করতে হয় তা শিখেছি। এটা একটা বিরাট অভিজ্ঞতা। ওই দুই বছরে আমি পাঠ্যবই থেকে যা শিখেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি শিখেছি স্টুডেন্ট ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে।

গ্রাজুয়েশন শেষ হওয়ার পর আমি আমার ক্যারিয়ারের জন্য এমন প্রতিষ্ঠান খুঁজছিলাম, যারা নতুন প্রজন্মের ক্ষমতায়নে কাজ করে, যারা পরিবর্তনের সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করে। আমার এই আকাঙ্খাই আমাকে অশোকার কাছে নিয়ে আসে। ২০১৪ সালে আমি অশোকাকে খুঁজে পাই। তারপর থেকে এখানেই কাজ করছি। আমি ইতিমধ্যে ছয়টি দেশের কয়েক হাজার মেধাবী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজ করেছি।

আপনি এখন অশোকাতে কোন পদে আছেন?

আমার দাপ্তরিক পদবী হচ্ছে ‘চেঞ্জমেকার ক্যাম্পাস নেটওয়ার্ক ম্যানেজার’। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ‘চেঞ্জমেকার ক্যাম্পাস’ হচ্ছে সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক পদবী। বিশ্বের ১০টি দেশে ৪৫জন মানুষ এই পদ নিয়ে কাজ করছেন। প্রায় ৪০ বছর ধরে অশোকা এই ‘চেঞ্জ মেকার’ প্রকল্প পরিচালনা করছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, সারা বিশ্বের সম্প্রদায়ের মধ্যে উদ্ভাবনী পরিবর্তন আনতে কাজ করে যাচ্ছে এই প্রকল্প।

আপনি এখন যে প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়েছেন, তার নাম ‘সমস্যাকে বোঝা’। বিষয়টি সত্যিই খুব জটিল। সমস্যা বোঝা সহজ বিষয় নয়। আপনি কী একটু ব্যাখ্যা করবেন?

মাঝে মাঝে আমরা দেখি, কোনো কোনো শিক্ষার্থী মুনাফার আশা করে অথবা না করে সামাজিক উদ্যোক্তা হচ্ছে, কেউ কেউ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। বিশ্বকে বদলে দেয়ার এক ধরনের সামাজিক দায় রয়েছে তাদের মধ্যে। আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে হ্যাকাথন প্রোগ্রাম, এক্সলারেটর ইত্যাদি প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তাদেরকে খুঁজে বের করি। তারপর তাদেরকে প্রয়োজনাীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষতা বাড়িয়ে কোনো একটা ভেঞ্চারে অন্তর্ভুক্ত করিয়ে দেই। স্ট্যানফোর্ড সোস্যাল ইনোভেশন জার্নালের এক লেখায় ড্যানিয়েলা পাপি বলেছেন, উদ্যোক্তাবৃত্তিক শিক্ষায় সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলো হচ্ছে: সচেতনতার সমস্যা, চিন্তা-ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গিজনিত সমস্যা, দক্ষতা অর্জন ও নিজেকে বোঝা, সমাজ ও রাষ্ট্রকে কিছু দেয়ার মানসিকতা ইত্যাদি।

এই সমস্যাগুলো নিয়ে কেন ভাবা উচিত? ভাবা উচিত এজন্য যে, এ গুলোর উপর নির্ভর করছে লক্ষ-কোটি টাকার স্টার্টআপ। তাই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া জরুরি। যেমন: যে ধরনের স্টার্টআপ শুরু করতে যাচ্ছি তা কি বাজারে বিদ্যমান? এটি কী সমাজের জন্য খুবই উপকারী একটি সমাধান? এটি কী সমস্যার একেবারে মূল উৎপাটন করতে সক্ষম হবে?

চারজন অশোকা ফেলো মিলে ‘ইট টেকস ভিলেজ’ নামে একটি স্টার্টআপ চালু করেছেন। এ ধরনের সামাজিক উদ্যোগে অশোকা কীভাবে সহায়তা করে থাকে?

গত ৪০ বছরে সারা বিশ্বে অন্তত চার হাজার নেতৃত্ব তৈরি করেছে অশোকা। আমরা তাদেরকে অশোকা ফেলো বলি। এদের কেউ কেউ কৃষিক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেছেন, কেউ শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন পরিবর্তন এনেছেন, কেউ স্বাস্থ্যখাতে চিকিৎসার কোনো সমাধান এনেছেন। চল্লিশ বছর ধরে এসব ফেলো তৈরি করতে গিয়ে আমরা দেখেছি যে সব উদ্যোক্তার মধ্যেই পাঁচটি জটিল দক্ষতা রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে: সহমর্মীতা, দলগত কাজ, নেতৃত্ব, ভিন্নভাবে চিন্তা করা এবং পরিবর্তন আনা।

এসব বৈশিষ্ট যাদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় তাদেরকে সহায়তা করে থাকে অশোকা।

আমি প্রায়ই তর্ক করি এই বলে যে, সব উদ্যোগই সামাজিক উদ্যোগ। কারণ যেকোনো প্রযুক্তিগত উদ্যোগ বা উদ্ভাবনের একটি সামাজিক প্রভাব রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, প্রভাবটি ভালো নাকি খারাপ? ফেসবুকের কথাই ভাবুন। লাখ লাখ মিথ্যা রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনে ভরা। এর একটা সামাজিক প্রভাব তো আছে নিশ্চয়। আপনি কীভাবে দেখছেন বিষয়টিকে?

খুবই চমৎকার একটি প্রসঙ্গ তুলেছেন আপনি। আপনাকে ধন্যবাদ। অশোকা আপনার ভাবনার সঙ্গে একমত। অশোকা সবসময় তরুণ পরিবর্তনকামীদের অনুপ্রেরণা দিয়ে থাকে। তারা ছোট বড় বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। চল্লিশ বছর ধরে অশোকা এ রকম হাজার হাজার উদ্ভাবক তৈরি করেছে। আমাদের দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্ব দাবি করছে যে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা বিভিন্নখাতে আরও পরিবর্তন দরকার। এবং অবশ্যই ইতিবাচক পরিবর্তন।

সূত্র: দ্য জেরুজালেম পোস্ট

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শলমো মাইতাল। শলমো মাইতাল জেডভি গ্রিলিচেজ রিসার্চ সেন্টারের প্রধান ব্যক্তি।

ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: মারুফ ইসলাম

Sharing is caring!

Leave a Comment