কম খরচে টেকসই শিক্ষার নাম ‘অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা’

কম খরচে টেকসই শিক্ষার নাম ‘অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা’

  • হ্যান্স তাপারিয়া

চল্লিশ বছর আগে আমেরিকায় জীবনে উন্নতি করার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পথ ছিল কলেজে পড়তে যাওয়া।  একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিষয়টি অধিকারের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সময়ের মধ্যে শিক্ষার হার অন্তত ২৬০ শতাংশ বেড়েছে, মূল্যস্ফীতি হয়েছে দ্বিগুণ। কেউ যদি বেসরকারি কোনো কলেজে চার বছর মেয়াদী কোনো বিষয়ে পড়তে চায় তবে এই গেল বছরেও তার খরচ হতো দুই লাখ মার্কিন ডলারের বেশি। আর পাবলিক কলেজে পড়তে খরচ হতো এক লাখ ডলারের বেশি। এই ব্যয় প্রথা ধরে রাখার জন্য আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অবস্থাপন্ন ধনী আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য তাদের দুয়ার উন্মুক্ত করে দিয়েছে।  একইসঙ্গে তারা ব্র্যান্ড ভ্যালুও তৈরি করতে চায়। সেই লক্ষে ক্ষেত্রবিশেষে তারা কোনো কোনো শিক্ষার্থীর পুরো টিউশন ফি ফ্রি করে দিচ্ছে।

কোভিড-১৯ ব্যবসার প্রচলিত মডেলকে প্রায় ধ্বংস করতে চলেছে। বেকারত্ব এত বড় আকার ধারণ করছে যে তা প্রায় গণবেকারত্ব তৈরি করতে চলেছে। এ অবস্থায় অনেকের পক্ষেই কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আমেরিকা এখন মহামারীর কেন্দ্রবিন্দু এবং এই মহামারীর প্রভাবে অনেক শিক্ষার্থীই তাদের ভর্তি/নিবন্ধন পিছিয়ে দিচ্ছে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা জটিলতা এবং কাজের অনিশ্চয়তার কারণে তারাও নিবন্ধন করবে কি না সে ব্যাপারে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছে। এছাড়া ‘ট্রাম্প প্রভাব’-এর কারণে গত তিন বছর ধরেই আমেরিকায় বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হ্রাস পেতে চলেছে।

আমেরিকার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানগুলো ইতিমধ্যে খারাপ অবস্থার দিকে যাত্রা করতে শুরু করেছে। হার্ভার্ডসহ অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন কাটাসহ নানা কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। অন্যান্য বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন এই আশঙ্কার মধ্যে আছে যে, অনলাইনে ক্লাস চালিয়ে যাওয়ার কারণে অনেক শিক্ষার্থীই হয়তো টিউশন ফি আংশিক ছাড়ের দাবি তুলবে।

এখন পর্যন্ত বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় শখের বসে অনলাইন শিক্ষাকে চালু রেখেছিল। মহামারীসহ অন্যান্য কারণে এটি তাদের ব্যাকআপ পরিকল্পনা। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি এটিকে শখের পরিকল্পনা মনে না করে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থাকে কৌশলগতভাবে গ্রহণ করে তবে তাদের অনেক ব্যয় লাঘব হবে এবং ভবিষ্যতে এরকম মহামারী পরিস্থিতিতেও তারা উপার্জন অব্যাহত রাখতে পারবে।

একটা বিষয় পরিষ্কার যে, মার্চ মাসে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে অনলাইন শিক্ষায় চলে যাওয়াটা অনেকেই ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। শিক্ষকরা রাতারাতি পাঠ্যক্রম পুনর্নিমার্ণে বাধ্য হয়েছেন। এরমধ্যে আবার ‘জুম বোম্বাররা’ জুমের শিথিল নিরাপত্তা ব্যবস্থার সুযোগটা গ্রহণ করেছে। ফলে দূরবর্তী অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এই নতুন প্রযুক্তি দ্রুততার সঙ্গে না শিখে বরং ফাঁকি দেয়ার বিষয়গুলো আয়ত্বে এনেছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করে, অনলাইনে ক্লাসে মানসম্মত শিক্ষা অর্জন করা যায় না।

নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের টিশ স্কুল অফ আর্টসের একজন অধ্যাপক অনলাইনের মাধ্যমে তার শিক্ষার্থীদের একটি নাটকের কোর্স পড়িয়েছিলেন। সেখানে শিক্ষার্থীরা ওকুলাস কোয়েস্ট হেডসেটগুলি ব্যবহার করে ভার্চুয়াল বাস্তবতায় একে অপরের সাথে “অভিনয়” করতে পারত। আবার স্ট্যানফোর্ডের একজন সংগীত অধ্যাপক তার শিক্ষার্থীদের একটি সফ্টওয়্যায়েরর মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। সফটওয়্যারটির মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানের সঙ্গীতজ্ঞরা ইন্টারননেট স্ট্রিমিং ব্যবহার করে একসঙ্গে প্রশিক্ষণ দিতে পারতেন। এভাবেই শিক্ষকরা নতুন নতুন পথ তৈরি করছেন, নতুন নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করছেন যা আগে কখনো দেখা যায়নি। এসবই অবশ্য কয়েক বছর আগের ঘটনা। বর্তমানে অনলাইন শিক্ষায় যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটেছে।

মহামারীটির আগে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ই অনলাইনে শিক্ষা কার্যকর করেনি। বছরের পর বছর ধরে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অধ্যাপকদের অনলাইনে কযেকটি কোর্স করার অনুমতি দিয়েছে। শিক্ষকরা সেগুলো এডএক্স বা কোর্সেরার মতো কিছু প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে পরিচালনা করে থাকেন। তবে খুব কম সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়ই তাদের জনপ্রিয় কোর্সগুলো অনলাইনের মাধ্যমে পরিচালনা করে থাকে। অনলাইনের মাধ্যমে স্ট্যানফোর্ডের এমবিএ কিংবা এমআইটির জীববিজ্ঞান ডিগ্রি এখনও পাওয়া সম্ভব নয়।

একদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষা গ্রহণের সুযোগকে সীমাবদ্ধ রাখতে চায় না, তাই তারা শিক্ষা বিস্তারের পরিধি বাড়াচ্ছে। ফলে ফিজিক্যাল ক্যাম্পাসের অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। এসব কারণে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনলাইন শিক্ষার ব্যাপারে দ্বিধা প্রকাশ করছেন। তারা বলছেন, আলোচনাভিত্তিক যেসব কোর্স রয়েছে সেগুলো অনলাইনের মাধ্যমে কতটা আন্তরিকতাপূর্ণভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব? তাছাড়া ল্যাবের ক্লাসগুলোই বা কীভাবে পরিচালিত হবে?

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রধান প্রধান যেসব ডিগ্রি প্রোগ্রাম রয়েছে সেগুলোর জন্য ‘সমান্তরাল’ অনলাইন ডিগ্রি তৈরি করা দরকার। এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাতে পারবে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যয়ও হ্রাস পাবে।

ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন শিক্ষার ব্যাপারে পথ দেখিয়েছে। তারা রীতিমতো উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। জর্জিয়া টেক নামের একটি শীর্ষস্থানীয় প্রকৌশল স্কুল ২০১৪ সালে কম্পিউটার বিজ্ঞানে একটি অনলাইন মাস্টার্স চালু করেছিল। এই ডিগ্রির জন্য ব্যয় হয় মাত্র সাত হাজার ডলার। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি আছে। এটিই এখন দেশটির সবচেয়ে বড় কম্পিউটার প্রোগ্রাম। এই অনলাইন ডিগ্রির মাধ্যমে ক্যাম্পাসের উপার্যন কমে গেছে তা নয়। বরং একটি পৃথক জনগোষ্ঠীর কাছে এই মর্যাদাপূর্ণ ডিগ্রি পৌঁছে দেয়া গেছে।

একইভাবে ২০১৫ সালে ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয় ২২ হাজার ডলারের একটি অনলাইন এমবিএ চালু করেছে।

এটি করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কার্যক্রমকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। ক্লাসরুমগুলোকে নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে সংযুক্ত করা প্রয়োজন যাতে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সারা বিশ্বের শিক্ষার্থীরা যুক্ত হতে পারে। শিক্ষকদেরও অনলাইন শিক্ষার ব্যাপারে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। আজ প্রায় সমস্ত তাত্ত্বিক বিষয় যেমন রসায়ন, কম্পিউটার বিজ্ঞান বা ফাইন্যান্স—সবকিছুর লেকচার আগাম তৈরি করা যেতে পারে এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করা যেতে পারে।

এমআইটি ইতিমধ্যেই একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ফেলেছে। তারা অনলাইনে বায়োলজি কোর্স চালু করেছে। কোর্সটিতে এই সেমিস্টারে ১ লাখ ৩৪ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে।

দিনে দিনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লাইব্রেরি অনলাইন লাইব্রেরিতে রূপান্তরিত হবে। অনলাইন ও অফলাইন—উভয় ধরনের শিক্ষার্থীরা এ লাইব্রেরি ব্যবহার করতে পারবে। এটি হবে সবচেয়ে বড় লাইভ ইন্টারঅ্যাকশনের জায়গা। তিন ঘণ্টার বিরক্তিকর লেকচারগুলো ক্রমশ অতীতের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এর পরিবর্তে একটা সাধারণ দিন, একটা সমস্যার সমাধান, প্রশ্ন-উত্তর, আলোচনা ইত্যাদির মাধ্যমে এক ঘণ্টার সেশনে বিভক্ত হবে।

লকডাউনের পর এই ফল সেমিস্টারে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পুণরায় ক্যাম্পাস খুলতে চাচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে ব্যবসার মডেলটিকেও নতুনভাবে সাজাতে হবে। তবে হুটহাট করে কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়াই ভালো। এতে অনেক সময় হীতে বিপরীত হয়। যেকোনো ভুল সিদ্ধান্ত মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। এই মহামারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য বিপদের পাশাপাশি অনেক সুযোগও তৈরি করেছে। এই সুযোগ গ্রহণ করতে পারলেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আগের মতো সচল হয়ে উঠবে।

হ্যান্স তাপারিয়া : নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ক্লিনিক্যাল অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর।

সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস

ইংরেজি থেকে অনুবাদ : মারুফ ইসলাম

Sharing is caring!

Leave a Comment