করোনা মহামারি এবং রিয়েল এস্টেট বিষয়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার প্রয়োজনীয়তা

করোনা মহামারি এবং রিয়েল এস্টেট বিষয়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার প্রয়োজনীয়তা

  • মোঃ রাইহানুল ইসলাম লাজু

সবকিছু ভালোই চলছিল, মানুষের জীবনযাত্রা, অর্থনীতি, ব্যাবসায়- বানিজ্য সব। গেল বছরের শেষদিকে হঠাৎ করে দেখা দিল করোনা ভাইরাসের মহামারী রূপ। মজাকরে অনেকে এটাকে “করুনা” ও বলছে। হেন কোন খাত নেই যেখানে পরেনি করোনার থাবা। এমন কোন দেশ নেই যারা শান্তিতে আছে এই করোনাকালীন সময়ে। সভাবগত ভাবেই বেশিরভাগ দেশই যথাযথ সময়ে গুরুত্ব দেয়নি এবং না দেয়ার ফলে যা হওয়ার তা হচ্ছে এবং আমরা তা দেখছি, বেশিরভাগ সময়ই চুপ-চাপ করে- ঠিক নীরব দর্শকের মত। দিনক্ষণ গুনতে গুনতে শেষ ই হচ্ছে না যেন। কবে যাবে করোনা, কবে স্বাভাবিক হবে পৃথিবী এই জিজ্ঞাসা অনেকের, যদিও কারো কাছেই সঠিক জবাব নেই। এক এক করে পৃথিবীর প্রায় সব দেশ আক্রান্ত হয়ে গেল, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ও এর বাইরে নয়, থাকবেই বা কিভাবে। তবে অনেকের মতে আমরা যথেষ্ট সময় পেয়েছিলাম এবং সেটাকে কাজে লাগালে মহামারীর ভয়াবহতা অনেকটাই কমানো যেত কিন্তু আমরা খাম খেয়ালি করে বা গায়ের জোরে বা বোকামি করে সময়কে কাজে লাগাইনি। তবে সময়মত ব্যাবস্থা নিলেও কী – ই বা করা যেত বা করতে পারতাম? যেখানে স্বয়ং বিশ্বমোড়লরাই রীতিমত হিমসিম খাচ্ছে সেখানে আমারা যে অনেক্ কিছু করে ফেলতাম এটা ভাবা বোধয় ঠিক হবে না। যাইহোক খোশগল্প না বাড়িয়ে কাজের কথায় আসি। এই করোনায় সবাই যেন অসহায় হয়ে তাকিয়ে আছে। পরিবার-পরিজন, চাকরি, ব্যাবসায় বানিজ্য, সমাজ ও রাষ্ট ব্যাবস্থা সব কিছুকেই একরকম স্তব্ধ করে দিয়েছে এই কভিড-১৯ নামের করোনা ভাইরাস। ইচ্ছা থাক বা না থাক সব খবর এমনিতেই চলে আসে আর যেহেতু অর্ধযুগের বেশি সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি ছাত্রছাত্রিদের সাথে এক আত্মার সম্পর্ক হয়ে গেছে। ওদেরকে নিয়ে ভাবনা টা জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। এই সেদিনের কথা। তখনো বাংলাদেশে করোনা আসে নি। মিডটার্ম পরিক্ষা সবে শেষ করে আমাদের ক্লাস শুরু হয়েছে। যেহেতু আমি সর্বশেষ সেমিস্টারের কোর্স পড়াই অনেকেই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে তাঁদের চিন্তা ধারা শেয়ার করে। অনেকের সাথে কথা হচ্ছিল নানা বিষয়ে। অনেকে সি এ পড়তে চায়, অনেকে বিদেশে গিয়ে মাস্টার্স করতে চায় আবার অনেকে বলে তাঁদের দরিদ্র বাবা মা কে একটু সাপোর্ট করতে হবে, আগে একটা চাকরি করতে হবে। অনেকে আবার উদ্যোক্তা হতে চায়। এসব নিয়ে আমাদের সময় ভালোয় যাচ্ছিল। হঠাত করোনা উঁকি দেয়া শুরু করলো আমাদের দেশে। মার্চের মাঝামাঝি কোন একদিন,আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭১ মিলনায়তনে করোনা শীর্ষক আলোচনা। পিছন দরজা দিয়ে ঢুকে বসলাম। IEDCR এর ডঃ আলমগীর খুব সাবলীলভাবে বিস্তারিত আলোচনা করছিলেন এবং আমাদেরকে সাহস দিচ্ছিলেন। করোনা তেমন কিছু না, তবে করোনা যদি এসেই যায় তাহলে কী কী করতে হবে, মেনে চলতে হবে এসব ও ছিল ওনার আলোচনার বিষয়। আমি শিক্ষক হওয়ায় চুপচাপ শুনছিলাম বটে, কিন্তু পিছনের দিকে কিছু ছাত্রছাত্রি দুষ্টামি করে হাসাহাসি করছিল। কেনই বা করবে না। ওরা তো তখন ও স্বপ্ন দেখছিল। করোনা তখনও ওদের চিন্তায় আসেয় নি। মাত্র তিন মাসের ব্যাবধানে আজ আমার ছাত্রছাত্রিরা হিসাব মিলাতে পারছে না, সত্যি বলতে আমি নিজেও পারছি না। চারিদিকে শুধু করোনা আর করোনা,করুনার বরই অভাব। অনেক ব্যাবসায় বানিজ্য বন্ধ বা বন্ধের মত অবস্থা। বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার আভাস। নতুন চাকরি তেমন কারো হচ্ছে না। বরং অনেকের চাকরি চলে যাচ্ছে। বেতন কমে যাচ্ছে। কর্পোরেটগুলো তাদের স্ট্রটেজি পরিবর্তন করছে অনেকটাই বাধ্য হয়ে। খবরে আসছে বিদেশ থেকে লোকজন ফেরত আসছে এবং আরো আসবে বলে প্রতিয়মান। এমন হযবরল অবস্থায় কোমলমতি ছাত্র ছাত্রিরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত এবং প্রতিনিয়ত তা বাড়ছে। আমার সাম্প্রতিক এক গবেষনায় দেখা গেছে যে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তিত। দেশে বিদেশে শুধু চাকরি ছাটাই এর খবর, উন্নত দেশ গুলো নিচ্ছে না বিদেশি কর্মিদের দায়ভার। কোন উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে নীজ দেশে আসতে হচ্ছে। শোনাযাচ্ছে শুধু মধ্যপ্রাচ্য থেকেই দশ লাখ কর্মি বাংলাদেশে ফেরত আসবে। অন্য গবেষনায় দেখা গেছে বিদেশে যারা আছে তাঁদের শতকরা ৯৩ ভাগ ভাগ মানুষের আয় মারাত্তকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এসব কারনে যদি সত্যি সত্যি ১০ লাখা বা আরো বেশি রেমিট্যান্স যোদ্ধা দেশে আসে তখন কী হবে? যা হবার হবে। কী হতে পারে সেটা নিয়ে আরেকদিন লিখবো হয়তো। এখন আসি দেশের প্রেক্ষাপটে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যানে বা অকল্যানে এখন কিন্তু সংবাদ বা দুঃসংবাদ কোনটাই আর চাপা থাকছে না। দেশে করোনার এই পরিস্থিতিতে একদিকে সরকার প্রধান সবকিছু সামলাতে রীতিমত হিমসিম খাচ্ছে অন্যদিকে বিরাট বিরাট কর্পোরেটরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে কর্মী ছাটাইয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের মাঝে তুমুল গ্রহনযোগ্য মোটিভেসনাল স্পিকার রুবানা হক ও কর্মী ছাটাইয়ের আভাস দিয়েছেন। ইতোমধ্যে যে কয়েক লক্ষাধিক মানুষ চাকরি হারিয়েছে আমি নিশ্চিত। প্রাইভেট সেকটরে নাকি দের কোটি মানুষ চাকরি হারাবে। ফেইসবুকে দেখা যাচ্ছে চাকরি হারিয়ে মানুষ পরিবার নিয়ে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে যাছে, ঢাকা শহরে বাসায় বাসায় ঝুলছে বাসা ভাড়ার বিজ্ঞপ্তি (টু-লেট)। ধরে নিলাম এসব খবর আংশিক সত্যি। তবে করোনার বর্তমান চিত্র দেখে সহজেই অনুমেয় যে অবস্থা সেদিকেই গড়াচ্ছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য অনেক দেশে ইতোমধ্যেই আবাসন খাতে কিছুটা মন্দা দেখে দিয়েছে। মে মাসে যুক্তরাজ্যে বাড়ির দাম আগের মাসের তুলনায় ১ দশমিক ৭ শতাংশ কমেছে। বাংলাদেশে ও এর প্রভাব পরবে খুব ই স্বাভাবিক। করোনার প্রভাবে বাংলাদেশেও কমেছে ফ্ল্যাট কেনাবেচা। এমন পরিস্থিতিতে নতুনরা চাকরির বাজারে কেমন সুবিধা করতে পারবে বলা কঠিন। রিয়েল এস্টেট খাতেও অনেকটা কঠিন হবে বলা যায়। তবে মানতে কষ্ট হলেও এটাই সত্যি যে এরেই মাঝে বেঁচে থাতে হবে সবার। এই সমস্যার মধ্যে থেকেই চেষ্টা করতে হবে সুযোগ খুজে নিতে। যেহেতু রিয়েল এস্টেট সেক্টর মানুষের মৌলিক চাহিদা নিয়ে কাজ করে, এই করোনাকালে তাদের জন্য নতুন সুযোগ থাকতে পারে। সেটা খুঁজতে হবে এবং আমি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি যে প্রতিটি সমস্যার মধ্যেই লুকায়িত থাকে সুপ্ত সম্ভাবনা এবং সেই সুপ্ত সুযোগ কে কাজে লাগাতে হবে, সময় থাকতেই সজাগ হতে হবে। একটু গভিরভাবে ভাবলে দেখা যাচ্ছে যে করোনার কারনে মানুষ যত সমস্যাতেই পড়ুক বাঁচার জন্য কিন্তু যাচ্ছে বাড়িতেই। বিদেশ থেকেও আসছে দেশে। কারণ কী? কারণ খুব ই সহজ। পৃথিবীতে মানুষের সবচেয়ে শান্তির জায়গা হচ্ছে আপন বাড়ি, আপন দেশ। নিজের বাড়িতে নাকি ডালভাত খেয়েও ঘুম ভালো হয়। গোস্ত পোলাও লাগে না। এই ধারনাটাকেই কাজে লাগাতে পারে আমাদের আবাসন খাত বা রিয়েল এস্টেট সেক্টর। মানুষের আয় বা সামার্থ্য কমলেই নিজের একটি ঠিকানা বা বাড়ি কেনার আগ্রহ যে কমে যাবে ব্যাপার টা এমন না। বরং এখান থেকেই অনেকের নিজের বাড়ির প্রতি আকাঙ্ক্ষা প্রবল থেকে প্রবলতর হতে পারে। এই ধারনার বাস্তবায়নের জন্য আবাসন খাতে প্রয়োজন হবে নতুন নতুন ধারনা বা কনসেপ্ট। এসব সুযোগ কে কাজে লাগাতে হলে রিয়েল এস্টেট বিষয়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার প্রয়জনীয়ত উপলব্ধী করতে হবে। সম্মিলিত পরিকল্পনা করতে হবে, শুধু একার কথা ভাবলে হবে না।

শুধু ব্যাবসায় করলেই হবে না, মন দিতে হবে গবেষণাতেও। শুধু বিলাসবহুল এপার্টমেন্ট বানালেই হবে না। ভাবতে হবে ক্রেতাদের সামর্থের দিকেও। শুধু বড়বড় শহর বা প্রাইম লোকেশনে নয়, প্রোজেক্ট করার আগে ভাবতে হবে ওই এলাকার সম্ভাব্য ক্রেতাদের সামার্থ্য এবং ইচ্ছার কথাও। মনে রাখতে হবে পন্য তৈরি করার আগেই কিন্তু বিক্রি করার নিয়ম। ক্রেতাদের ঘাড়ে শুধু একটা গৃহঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে পণ্য বিক্রি করেই খালাস- এমন ধারনা থেকে বেরিয়ে আস্তে হবে। তাঁদেরকে কিভাবে সহজ শর্তে ঋণের ব্যাবস্থা করে দেয়া যায় সেটাও ভাবা দরকার। অন্যদিকে আবাসন ব্যাবসায়ীদেরকে শুধু বেশি মুনাফার কথা ভাবলে চলবে না। মনে রাখতে হবে মানুষ বাঁচলে দেশ বাঁচবে, দেশ বাঁচলে অর্থনীতি বাঁচবে। মুনাফা পরেও করা যাবে। সাম্প্রতিক এক গবেষনায় দেখা গেছে শতকরা ৬০ ভাগ মানুষের নিজস্ব ফ্ল্যাট বা বাড়ি কেনার পরিকল্পনা আছে। সংখ্যাটা কিন্তু অনেক ভাল। এসব অপর্চুনিটি বা সম্ভবনাকে কাজে লাগাতে পারলে রিয়েল এস্টেট খাঁতে ভাল স্বপ্ন দেখার যথেষ্ট সুযোগ আছে। বড় বড় কোম্পানি গুলোকে গবেষণাতেও বিনিয়োগ করতে হবে। REHAB কে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা পালন করতে হবে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যৌথ গবেষণা হতে পারে। যথাযথ গবেষণা এবং সঠিক কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে আবাসন খাতে সুদিন নিয়ে আসা সম্ভব। এসবের বাস্তবায়ন্ হলে রিয়েল এস্টেট সেক্টরে অনেক কর্মসংস্থান ও সৃষ্টি হবে ইনশাআল্লাহ্‌। আর যারা আবাসন খাত বা রিয়েল এস্টেট সেক্টরে কাজ করতে চান বা এই বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছেন তাঁদেরকে নতুন নতুন বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে, শিখতে হবে অনেক। গতানুগতিক পড়াশোনা করলে চলবে না, প্রায়োগিক বিষয়ে হতে হবে অনেক পারদর্শি। ছাত্র জীবন থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি গবেষনায় মনোনিবেশ করতে হবে এবং কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের আগেই কর্মক্ষেত্র সমন্ধে ধারনা রাখতে হবে। শুধু স্বপ্ন দেখলে হবে না, মেধা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে কাজ করতে হবে। বাড়ির মতো কোনো স্থান নেই, এ কথা মাথায় রেখে আগাতে হবে।

লেখক

গবেষক ও শিক্ষক, রিয়েল এস্টেট বিভাগ

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।

Sharing is caring!

Leave a Comment