অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম  :  বদলাতে হবে ধারণা, শিখতে হবে কৌশল

অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম : বদলাতে হবে ধারণা, শিখতে হবে কৌশল

  • মো. সাদরিল ইসলাম খান

করোনা ভাইরাসের এই কঠিন সময়ে বর্তমানে প্রায় সারাবিশ্বে ক্লাসরুমে সরাসরি শিক্ষাদান বন্ধ আছে । বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে । বাংলাদেশে প্রথমে ড্যাফোডিলসহ বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন ক্লাস শুরু করলেও, বর্তমানে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এবং কোভিড-১৯ মহামারীর দীর্ঘসূত্রিতায় বিভিন্ন সরকারি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে দেরিতে কিংবা সীমিত পরিসরে হলেও অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছে । করোনা ভাইরাস নিয়ে আমরা এখনো পর্যন্ত এমন কোনো ইঙ্গিত পাইনি যাতে আমরা মনে করতে পারি যে নিকট ভবিষ্যতে আমরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাব । তবে প্রযুক্তি আমাদের বর্তমান বদ্ধ জীবনকে অনেকটা স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করছে । শুধুমাত্র শিক্ষা ক্ষেত্রে নয় বরং ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, দাপ্তরিক কাজে এমনকি আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও, প্রযুক্তি আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। যেমন আমার এই লেখাটি, আমি কিন্তু এটা কি-বোর্ডে লিখিনি, বরং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর মাধ্যমে আমার কথাকে লেখাতে রূপান্তর করে প্রকাশ করেছি, যা অনেক সহজতর। এটি সহজেই অনুমেয় যে পরবর্তী পৃথিবীতে টিকে থাকার লড়াইয়ে প্রযুক্তিগত দক্ষতা হবে অন্যতম নির্ণায়ক ।

অথচ অনলাইন ক্লাস অথবা শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে আমরা এখনো সবাই ইতিবাচকভাবে ভাবতে পারছি না। প্রথমত, আমরা যেন এখনো এই পদ্ধতিটি সহজভাবে গ্রহণ করতে পারছি না । কিন্তু আমরা যদি একটু ভেবে দেখি, লকডাউন এর বেশ আগে থেকেই  আমরা শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেকটাই প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি । যেমন একটা সময় ছিল যখন আমরা ক্লাসরুমে হয়তো ব্ল্যাকবোর্ড-চক ব্যবহার করতাম । কিন্তু এখন সে জায়গাগুলো দখল করে নিয়েছে পাওয়ার-পয়েন্ট স্লাইড, বিভিন্ন শিক্ষামূলক অ্যাপ্লিকেশন এবং ভিডিও। আবার অনলাইন ক্লাস নিয়ে আমাদের অনেকের একরকম সন্দেহ আছে যে এর কার্যকারিতা কেমন অথবা কঠিন হবে কিনা । কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে প্রযুক্তিগত এই সমৃদ্ধির যুগে, বর্তমানে খুব সহজে এবং কার্যকরভাবে অনলাইনে যাবতীয় শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়। এ কথাটি আমি নিজের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি ।

অনলাইন ক্লাসের কথাই যদি বলি, তাহলে বিভিন্ন অ্যাপ যেমন – জুম, বিগ ব্লু বাটন, গুগল মিট ইত্যাদি ব্যবহার করে খুব সহজেই ক্লাস সম্পন্ন করা যায় । এ সকল অ্যাপ এ রয়েছে স্ক্রিন শেয়ার থেকে শুরু করে রেকর্ড করার অপশন । আমরা যদি ক্লাসে কিছু এঁকে বা লিখে বোঝাতে চাই তাহলে সে সুযোগও রয়েছে। অনলাইনে ক্লাসের আরেকটি সুবিধা হচ্ছে আমরা চাইলে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই স্ক্রিন পরিবর্তন করে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ওয়েবসাইট, ভিডিও অনেক সহজে দেখাতে পারি, যেটা সরাসরি ক্লাসে কিছুটা সময়সাপেক্ষ ।

অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে একটি নিজস্ব লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম – LMS । যখন আমি যুক্তরাজ্যে মাস্টার্স করছিলাম তখন দেখেছিলাম একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার প্লাটফর্ম হচ্ছে নিজস্ব LMS, হোক দূরশিক্ষণ অথবা সরাসরি শিক্ষন।  যেমন ওখানে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ব্ল্যাকবোর্ড’ LMS সফটওয়্যারটি ‘ইউনিলাইফ’ নামে ব্যবহার হতো ।  বাংলাদেশ এ ধরনের নিজস্ব LMS থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি তাদের নিজস্ব লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ‘DIU BLC’ অনেক দিন ধরে ব্যবহার করে আসছে যেটির মূল সফটওয়্যার হচ্ছে, ‘মুডল’। এ উদ্যোগ সত্যিই অনেক প্রশংসনীয়। কথাটি আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নয়, বরং নিরপেক্ষভাবেই বলছি। উন্নত দেশের শিক্ষা পদ্ধতি সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে, তারা সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন ব্যাপারটি।

অনলাইনে পরীক্ষা অথবা নিরীক্ষণের ব্যাপারটি অনেকটা ওপেন বুক সিস্টেমের উপর নির্ভরশীল। এই পদ্ধতি সারা বিশ্বব্যাপী বহুল প্রচলিত। উন্নত বিশ্বে অধিকাংশ কোর্স বহুলাংশে বিভিন্ন এসাইনমেন্ট এবং সৃজনশীল পরীক্ষার উপর নির্ভরশীল। এমনকি এমন কোর্সও আছে, যেগুলোতে কোন লিখিত পরীক্ষাই নেই, বরং পুরোটা এসাইনমেন্ট আর থিসিস।  এতেই বুঝা যায় যে কতটা নির্ভরযোগ্য আর শক্তিশালী এই পদ্ধতি। বিশ্বব্যাপী গবেষক আর উদ্যোক্তা তো সৃজনশীলতার মাধ্যমেই তৈরী হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী বিভিন্ন অনলাইন ওয়েবসাইট, জার্নাল পেপার এবং গবেষণার মাধ্যমে তার নিজস্ব অ্যাসাইনমেন্ট এবং উত্তর সাজাতে পারেন। নেই কোন নকলের সুযোগ কেননা প্লেজারিজম ডিটেকশন সফটওয়্যার এতে প্রোথিত থাকে। বিদেশে পড়ার সময় শুরুতে এতে মানিয়ে নিতে আমারও সমস্যা হয়েছিল, কেননা আমি তো এতে অভ্যস্ত ছিলাম না। তবে এখন যদি আমি ভেবে দেখি তবে আমি এর মাধ্যমে বহু কিছু শিখেছি। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে করোনা ভাইরাসের এই সময় আমরা এ ধরনের পদ্ধতি চর্চার মাধ্যমে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করতে পারি। আমাদের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার ভয়ে ভীত না হয়ে যেন শিক্ষার আনন্দে পড়াশোনাতে মগ্ন হতে পারে, এটা সেখানেই সাহায্য করবে।

মো. সাদরিল ইসলাম খান। ছবি: সংগৃহীত

সীমাবদ্ধতা সবকিছুরই আছে। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক কথাই বলা হয়। ভেবে দেখলে, আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা করোনা ভাইরাসের এই সময়ে কার্যকর হচ্ছে না, তাহলে এখানেও তো সীমাবদ্ধতা আছে। এই কঠিন সময়ে আমাদের সকলের উচিত সবাই একত্র হয়ে সকল সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে পরিস্থিতির সাথে মানানসই শিক্ষা কার্যক্রম চালানো। বিশ্বসেরা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সকল শিক্ষা কার্যক্রম পরবর্তী এক বছরের জন্য অনলাইনে পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বুঝাই যাচ্ছে নির্ভরযোগ্য না হলে তারা এ সিদ্ধান্ত নিত না। করোনাভাইরাস আমাদেরকে প্রযুক্তির সাথে যুক্ত হয়ে পরবর্তী পৃথিবীর জন্য প্রস্তুত হওয়ার আভাস দিচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থাও তাদের কৌশল পরিবর্তন করছে। যেমন ফেসবুক মেসেঞ্জার সম্প্রতি স্ক্রিন শেয়ারিং ফিচারটি যুক্ত করেছে, যেটি আগে ছিল না। অর্থাৎ বর্তমান এবং পরবর্তী বিশ্ব পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে আমাদের সকলেরই উচিত প্রযুক্তির সাথে নিজেদের আরো মানিয়ে নেওয়া। আমরা যদি চিন্তা করে দেখি, একটা সময় যেখানে টেলিভিশন-রেডিওসহ বিভিন্ন যন্ত্র ছিল আমাদের বিনোদনের মাধ্যম। অথচ আজকে এক ছোট মোবাইল ফোন আমাদের হাতের মুঠোয় সব কিছু এনে দিচ্ছে। বাস্তবতা বিবেচনা করলে, এখনো আমরা এমন কোন আভাস পাইনি যাতে বুঝব যে করোনা ভাইরাস অতি অল্প সময়ের মধ্যেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিবে। বিভিন্ন জায়গায় ভ্যাকসিন আবিষ্কারের সম্ভাবনার কথা শুনা গেলেও এখনো কোথাও শতভাগ কার্যকর কিছু প্রমাণিত হয়নি। তাহলে কতদিন এভাবে চলবে? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং গবেষকরা বলছেন যে লম্বা সময়, এমনকি কয়েক বছর হতে পারে। এই সময়ে যদি পড়াশোনা বন্ধ থাকে, তাহলে তো এই গোটা পৃথিবীই অচল হয়ে পড়বে। আবার অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে যদি আমরা এগিয়ে না যাই, তাহলে তো আমরা পিছিয়ে পড়ব। অনিশ্চয়তা আর সেশনজটের খপ্পরে পড়ে ঝরে যাবে অজস্র শিক্ষার্থী। তাই অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে নিয়ে আমাদের সকলেরই ইতিবাচক ধারণা চর্চা করা উচিত। সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সকল অভিভাবকদের এগিয়ে এসে আরো সহযোগিতা করা উচিত।  বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে তাকে মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়াই তো মানুষের কাজ।

লেখক : শিক্ষক, পরিবেশ বিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।

Sharing is caring!

Leave a Comment