ইউসুফের ওয়াইএসএসই

ইউসুফের ওয়াইএসএসই

  • মো. সাইফ

‘জীবন উৎস্বর্গ করে দিলাম ওয়াই.এস.এস.ই (YSSE) ‘র প্রতি।’ কথাটি যখন বলছিলেন তখন চোখে মুখে তার স্বপ্ন ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছিলো, মনে হচ্ছিলো বহুদূরের কোনো বাঁকা পথে যুদ্ধ করে পাড়ি দেয়ার দীপ্ত সংকল্প। ওয়াই.এস.এস.ই একটি তরুণদের দ্বারা পরিচালিত তরুণদের সংগঠন। যার প্রতিষ্ঠাতা শেখ মোহাম্মদ ইউসুফ হোসেইন। সামাজিক কাজে সমাজের জন্যে পুরো জীবনটাই যিনি সঁপে দিয়েছেন তার কাছে ওয়াই.এস.এস.ই সংগঠন একটি সন্তানতুল্যই। আর সন্তানের জন্যে সবকিছুর উর্ধে থেকে জীবনটাকে তো উতস্বর্গ দেয়াই যায়।

ওয়াই.এস.এস.ই কি

ওয়াই.এস.এস.ই-এর পূর্ণ-রূপ ‘ইয়ুথ স্কুল ফর সোস্যাল এন্ট্রাপ্রেনার্স’ ! ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে যাত্রা শুরু হয় এই সংগঠনের। সামাজিক এবং পরিবেশগত টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে তরুণদের উদ্ভাবনী চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে তাদেরকে সামাজিক উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার ফ্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে ইয়ুথ স্কুল ফর সোস্যাল এন্ট্রাপ্রেনার্স। শেখ ইউসুফ বলেন, সোস্যাল এন্ট্রাপ্রেনার্স-ভিত্তিক শুধু মাত্র তরুণদেরকে নিয়ে করা দেশের প্রথম সংগঠন এটি।

যেভাবে লো ওয়াই.এস.এস.ই‘র আইডিয়া

শেখ ইউসুফ মনে করেন, সব তরুণই নিজের মতো করে ভাবতে পছন্দ করে। তার নিজস্ব কিছু আইডিয়া থাকে। অনেকেই উদ্ভাবনীয় কিছু করে দেখাতে চায়। তবে তাদেরকে সহযোগিতা করার মতো তেমন কেউই এগিয়ে আসে না। বরঞ্চ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাকে দমিয়ে দিয়ে বলা হয় ‘এসব করে লাভ নেই,পড়াশোনা করে চাকরি খুঁজো’। অথচ, উদ্যোক্তা যে চাকরি-হীনতার বিপরীতে একটি সম্মানজনক পেশা হতে পারে এবং এ পেশা অবলম্বন করে সামাজিক দায়বদ্ধতা দূর করা যেতে পারে সেটি তাদেরকে বুঝানোর চ্যালেঞ্জ নিয়েই শুরু হয় ওয়াই.এস.এস.ই’র যাত্রা।

চাকুরি করো তবে…

চাকুরি করতে কখনোই বাঁধা নেই তবে শেখ ইউসুফ এর মতে, চাকরির আশায় থেকে সিভি নিয়ে দ্বারে দ্বারে গিয়ে জুতার তলা ক্ষয় করে সমাজের বোঝা হয়ে থেকে লাভ নেই। এছাড়া ঘুষ দিয়ে চাকুরি পাওয়ার চিন্তা করাও আত্মঘাতী বলে মনে করেন তিনি। একটি দেশের প্রায় তিনকোটি জনগন যখন বেকার জীবন নিয়ে হতাশায় ভুগছে তখন ওয়াই.এস.এস.ই মনে করছে চাকুরির আদর্শ বিকল্প হতে পারে সামাজিক উদ্যোগ কর্মসূচী। ঘুষ না দিয়ে সে টাকাই হতে পারে এক্ষেত্রে ব্যবসায়ের প্রাথমিক বিনিয়োগ।

কার্যক্রম

শুরু থেকেই আন্তজার্তিকভাবেও সংগঠনটির কাজকে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন শেখ মোহাম্মদ ইউসুফ হোসেইন। তাই ইয়ুথ স্কুল ফর সোস্যাল এন্ট্রাপ্রেনার্স ২১টি দেশে তাদের কাজের বিস্তার ঘটিয়েছে। ২০১৫ সালে ওয়ার্কশপ, সেমিনার এবং মোটিভেশনাল সেশন মিলিয়ে বড় প্রোগ্রাম হয়েছে ২১টি। এই প্রোগ্রামগুলোতে তরুণদের ছিল সরব উপস্থিতি। এছাড়া দেশের বাইরে হয়েছে ৫টি প্রোগ্রাম। বর্তমানে ইয়ুথ স্কুল কাজ করে যাচ্ছে ঢাকার গণ্ডি পেরিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায়। ইউসুফ বলেন, বেশিরভাগ সামাজিক সংগঠন ঢাকা-কেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ায় ঢাকার বাইরের তরুণরা জানার সুযোগ কম পাচ্ছেন। তাদেরকে সামাজিক উদ্যোগ সম্পর্কে বিশদ ধারনা দিতে চান তিনি।

নতুন প্রকল্প

ইয়ুথ স্কুল ফর সোস্যাল এন্ট্রাপ্রেনার্স বর্তমানে কাজ করছে চারটি প্রকল্প নিয়ে। এই চারটি প্রকল্প সাফল্যের সঙ্গে করতে চান ইউসুফ হোসেইন, কারণ তিনি মনে করেন সামাজিক উদ্যোগে একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে এই চারটি প্রজেক্ট।

১. উদ্যোগ ও উদ্যোক্তা: এই প্রকল্পের অধীনে একটি ব্যবসায় পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নে যাবতীয় সহযোগিতা করবে ওয়াইএসএসই। অনেকের কাছেই ব্যবসায় নিয়ে ভালো আইডিয়া রয়েছে। তবে তারা জানেন না কীভাবে শুরু করতে হবে। একটি ব্যবসায় সঠিক কাঠামোতে করতে হলে কিছু কাগজপত্র, ট্রেড লাইসেন্স ইত্যাদির দরকার পড়ে। এসব সম্পর্কে ধারনা দেওয়া হবে এই প্রকল্পে। অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টর যারা আইডিয়ার পিছনে বিনিয়োগ করবে তাদের সঙ্গে প্রয়োজনে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হবে। বিজনেস কমিউনিটি, নেটওয়ার্কিংও শেখানো হবে এখানে।

২. রুফ-টপ গার্ডেনিং: গৃহিণীদের সম্পর্কে বাংলাদেশে একটি সাধারণ ধারনা প্রচলিত আছে যে তারা শুধু বাড়ির গৃহস্থালি কাজ-ই করবে। অন্য কোনো কিছুতে তাদের জড়িত হবার কোনো সুযোগ নেই। তাদের জন্যই মূলত এই প্রকল্পটির উদ্ভব হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহায়তায় বাড়ির গৃহিণী ও নারীদের জন্য বাড়ির ছাদেই বাগান করে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করবে ওয়াই.এস.এস.ই। পরিবেশগত উপকার তো হবেই, পাশাপাশি নারীরা নিজেরাই কিছু করতে শিখবে এর মাধ্যমে।

৩. ম্যগাজিন: উদ্যোক্তাদের সাফল্য, পথচলা ইত্যাদি নিয়েই ম্যাগাজিনটি হবে বলে জানান শেখ মোহাম্মদ ইউসুফ হোসেইন। অনেকের ব্যবসায় নিয়ে নানান মতামত থাকে। সেসব অভিযোগ, অনুযোগ, পরামর্শ, খুটিনাটি তথ্য থাকবে এখানে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেকেই আছেন যারা নিজের চেস্টায় কাজ করে যাচ্ছেন। তাদের কাজগুলোকে তুলে ধরা হবে ম্যাগাজিনটিতে।

৪. বিজন্যাস কাউন্সেলিং সেন্টার: অনেকে না বুঝে ব্যবসায় শুরু করার পর পথ হারিয়ে ফেলেন। বুঝে উঠতে পারেন না কীভাবে এগোতে হবে। তাদেরকেই কাউন্সেলিং সেবা দেওয়া হবে। এছাড়া অলাভজনক উদ্যোগগুলোকে লাভজনক করার বিভিন্ন পরামর্শ ও সহযোগিতাও করা হবে। এই চারটি প্রকল্পের বাইরে বান্দরবনের একটি দুর্গম অঞ্চলে যেখানে একটি স্কুলও নেই, সেখানে একটি স্কুল করে দেবে ইয়ুথ স্কুল। এর কাজ শুরু হয়েছে যেখানে সকালে বাচ্চাদের জন্য এবং বিকেলে বরাদ্দ থাকবে বয়স্কদের জন্য শিক্ষা কর্মসূচী।

ওয়াই.এস.এস.ই যেভাবে তরুণদের উপকার করছে

ইয়ুথ স্কুল ফর সোস্যাল এন্ট্রাপ্রেনার্স এ যে কেউ অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করে সদস্য হতে পারবেন। সদস্যরা ইয়ুথ স্কুলের রেডিও, টেলিভিশন প্রোগ্রামগুলোতে যেতে পারে এবং নিজেদের মতামত তুলে ধরতে পারে দর্শক-শ্রোতাদের সামনে। এছাড়া সেমিনার, ওয়ার্কশপ এবং মোটিভেশনাল সেশন হয়। এখানে তরুণরা নিজেদের ভাবনাগুলো প্রকাশ করতে পারে। আইডিয়া নিয়ে ডিসকাশন করতে পারে। তাদেরকে পরিচর্যা করা হয়। ইনভেস্টর খুঁজে পেতে সাহায্য করা হয়।

ওয়াই.এস.এস.ই থেকে ট্রেনিং নিয়ে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম, নিউজ পোর্টাল, ওয়্যার হাউজসহ বিভিন্ন উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান তাদের ব্যবসায় শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন ইউসুফ হোসেইন। বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থা এমন এখানে যোগ্য ব্যাক্তি যোগ্য চাকুরি পায় না। এখানে উদ্যোক্তা হতে কখনো উৎসাহিত করা হয় না। তাই তরুণদেরকে অনুপ্রেরণা দিয়ে তাদেরকে সামাজিক উদ্যোগ সম্পর্কে জানায় ওয়াই.এস.এস.ই। তরুণরাও উপকৃত হচ্ছে এতে।

index2একজন শেখ মোহাম্মদ ইউসুফ

ওয়াই.এস.এস.ই বর্তমানে শেখ মোহাম্মদ ইউসুফের মুল ধ্যান জ্ঞ্যান। রাতদিন কাজ করে যাচ্ছেন। চষে বেড়াচ্ছেন দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। নিজেকে আদ্যপান্ত একজন অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তা হিসেবে গড়ে তুলেছেন। ইয়ুথ স্কুলে তার সাথেই কাজ করছেন আরো বেশ কজন তরুন। ওয়াই.এস.এস.ই কমিটি সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের নূর নাইম বলেন, ‘ইউসুফ ভাইয়া অনেক বন্ধুসুলভ, কাজ ছাড়াও তিনি নিয়মিত ফোন দিয়ে আমাদের খোঁজ নেন। প্রোগ্রাম এর আগে বেশ কষ্ট করে প্রোগ্রাম আয়োজন করেন। তবে পড়ালেখার জন্যে অগ্রাধিকার সব সময়। কখনো পড়া বাদ দিয়ে কাজের জন্য চাপ দেননি তিনি। মানুষ হিসেবে অত্যন্ত উদার মনের।’

বড় মনের বলেই অস্ট্রেলিয়ার স্কলারশিপ পেয়েও তা গ্রহণ করেননি শুধু নিজের কাজকে ভালবাসেন বলেই । কাজ করে যাচ্ছেন তরুণদের জন্যে। ‘সহায়’ নামের উন্নয়ন সংস্থা যেটি পরিবেশ ও কৃষি নিয়ে কাজ করে সেটি দিয়ে তার শুরু। ‘রাইট নাউ’ (Right Now) নামের আরেকটি সংগঠনও করেন তিনি। এরপর কাজ করেছেন তিন বছর নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে। একটি সামাজিক ব্যবসায় সম্মেলনে ড. মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে তার পরিচয়। সেখানে তিনি মুহাম্মদ ইউনুসের কথায় প্রচুর অনুপ্রেরণা পান। এরপর নিজ জন্মস্থান শেরপুরে তিনি প্রথম সামাজিক ব্যবসায়ের কাজ শুরু করেন।

স্যার ফজলে হোসেন আবেদ, সবুর খান, ড. মুহাম্মদ ইউনুসের মতো বড় বড় মানুষদের কাজ দেখে অনুপ্রেরণা পান ইউসুফ। এই অনুপ্রেরণা এবং নিজের পরিশ্রম দিয়ে সামাজিক উদ্যোক্তাদের বন্ধু-প্রতিম সংগঠন ইয়ুথ স্কুল ফর সোস্যাল এন্ট্রাপ্রেনার্স-এর পরিসরকে দিতে চান আরো বিস্তৃতি!favicon59

Sharing is caring!

Leave a Comment