নবায়নযোগ্য শক্তির খোঁজে ১০ উদ্ভাবন

নবায়নযোগ্য শক্তির খোঁজে ১০ উদ্ভাবন

  • এস. এম. আমানূর রহমান

নবায়নযোগ্য শক্তিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে তারুণ্যের প্লাটফর্ম ইয়াং বাংলা; বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পাওয়ার সেল এবং গ্রীন ডেল্টা ইনস্যুরেন্স কোম্পানির উদ্যোগে গত ২ মাসব্যাপী দেশজুড়ে আয়োজিত হয়েছে নবায়নযোগ্য শক্তির উদ্ভাবনী আইডিয়া প্রতিযোগিতা ‘বিচ্ছুরণ’, যার গ্র্যান্ড ফিনালে ১০ ডিসেম্বর সাভারের শেখ হাসিনা জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হয়।

বিচ্ছুরণ-এর গ্র্যান্ড ফিনালে-তে অংশগ্রহণকারী ৩০টি উদ্যোক্তা দলের মধ্য থেকে সম্মানিত বিচারকরা পিচিং রাউন্ড শেষে শীর্ষ ১০ উদ্ভাবনী আইডিয়া বাছাই করেন। পরে আমন্ত্রিত অতিথিদের উপস্থিতে শীর্ষ দলগুলোর হাতে তুলে দেয়া হয় পুরস্কার ও সনদ। পরবর্তীতে নির্বাচিত সেরা ১০টি প্রজেক্ট বা উদ্যোগ বাস্তবায়নে জন্য আর্থিক তহবিল এবং সার্বিক কারিগরি সহায়তা প্রদান করবে সরকারের পাওয়ার সেল, গ্রীন ডেল্টা ইনস্যুরেন্স কোম্পানি এবং ইয়াং বাংলা।

সারাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে উদ্ভাবনী আইডিয়া খোঁজার এই প্রতিযোগিতা ‘বিচ্ছুরণ’ গত ২১ অক্টোবর থেকে শুরু হয়। পূর্বনির্ধারিত সময়সূচী অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলে সেমিনার ও কর্মশালা। ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয় সহ সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রচারণামূলক ক্যাম্পেইন এর ফলে জমা পড়ে সাতশ’র বেশি উদ্ভাবনী আইডিয়া।

প্রতিযোগিতায় বিজয়ী দলগুলো জানায়, এ ধরণের উদ্যোগ নতুন প্রজন্মকে সহায়তা করবে নিজেদেরকে উদ্ভাবক হিসেবে গড়ে তুলতে। সেই সঙ্গে তরুণদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলতেও এ ধরণের উদ্যোগ সহায়তা করবে বলে জানায় তারা।

বিজয়ী ১০ দলের মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বিইউবিটি রিপ্রেজেন্টর। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে অংশ নেয়া এই দলের প্রধান ইমরান হোসেন বলেন, বেশ উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে আমরা অংশ নেই বিচ্ছুরণে। আমাদের প্রজেক্টের নাম হাইড্রো পাওয়ার ওয়াটার টারবাইন। এখানে ব্যবহৃত প্রযুক্তি পুরনো। কিন্তু এই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ব্যবহার করার আইডিয়া নতুন। আমাদের সেই আইডিয়া আজ বিদ্যুৎ জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্বীকৃতি পাচ্ছে।

যেহেতু মানুষ প্রতিদিনই পানির ট্যাপ ব্যবহার করে, সেখান থেকে হাইড্রো পাওয়ার ওয়াটার টারবাইন ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। কারণ এতে ব্যবহৃত মেটারিয়াল গুলো বাংলাদেশে পাওয়া সম্ভব এবং প্রসেসিং বেশ সহজ। যেহেতু এটি একটা নবায়নযোগ্য শক্তি, তাই এতে করে পরিবেশের কোন ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আর কমদামী হওয়াতে সবাই কিনবে। এই দলের সদস্য হিসেবে কাজ করছেন নাজিম উদ্দিন, নুরুজ্জামান নোবেল এবং আবু সাইদ।

ভোল্টেজ.আইও নাম নিয়ে বিচ্ছুরণে অংশ নিয়েছে ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রাপ্তি রহমান ও শোয়ায়েব খান। সিএসসি বিভাগের শিক্ষার্থী প্রাপ্তি জানায়, প্রেসার দিয়ে ইলেক্ট্রিসিটি তৈরির জন্য কাজ করেছি আমরা। আমাদের প্রজেক্ট পিজোইলেক্ট্রিক ন্যানো জেনারেটর টাইলসের মাধ্যমে প্রেসার তৈরি করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমরা কাজ করেছি। এ বিষয়ে আমাদের শিক্ষকেরাও দারুণ সাহায্য করেছে। বিষয়টি নিয়ে ভবিষ্যতেও ভালো কিছু করতে পারব বলে আশা করছি।

মাটি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দুর্দান্ত এক আইডিয়া নিয়ে এসেছে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে অংশ নেয়া দল ‘আননন’। দলটির প্রধান মো. সামিউল ইসলাম বর্ণ জানান, মাটি থেকে তারা ২০ ভোল্টের ব্যাটারি তৈরি করেছে যেখানে থাকছে .৮ এম্পায়ার এবং ১০ ওয়াট চার্জ। এই ব্যাটারি কখনও চার্জ দেয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা দেখিয়েছি কিভাবে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফ্লাইওভারের নিচে থাকা অব্যবহৃত স্থান থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ফ্লাইওভারকে আলোকিত করা যাবে। তাদের এই দলে আরও রয়েছেন

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে অংশ নিয়েছে গ্যাস অ্যান্ড পেট্রোল মডারেটর দল। দলটির প্রধান সাদিয়া আফরোজ বলেন, আসলে আমরা যতই এনার্জি তৈরি করি না কেনো, তা যদি যথাযথভাবে ব্যবহার করতে না পাড়ি তাহলে অপচয়ের কারণে দিন শেষে আমরা অভাবে থাকব। এর সে কারণে গ্যাস বা পেট্রোল যেন অপচয় না হয় সে জন্য আমরা একটি যন্ত্র তৈরি করেছি। গাড়ি দীর্ঘ সময় অকারণে চালু থাকলে বা গ্যাসের চুলা অকারণে চালু থাকলে তা বন্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থা করবে এটি।

ফেসবুক থেকে বিচ্ছুরণের কথা প্রথম জানতে পারেন সাদিয়া ও তার দলের অপর সদস্য আনিকা তাবাসসুম। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় সময়টাকে কাজে লাগানোর জন্য এই ইনোভেটিভ আইডিয়া নিয়ে তাদের কাজ করে যাওয়া। সাদিয়া বলেন, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালু কণা, বিন্দু বিন্দু জল কিভাবে মহাদেশ ও সাগর তৈরি করেছে তা আমরা জানি। কিন্তু এই শিক্ষা গ্যাস বা পেট্রোল ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমরা কাজে লাগাই না। আর সে কারণেই আমাদের মত সুবিধা ভোগীদের জন্য বাকিরা বঞ্চিত হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অংশ নেয়া দল ডিইউ প্রোঅ্যাক্টিভ নিয়ে এসেছে এমন এক স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা যার মাধ্যমে সোলার প্লান্ট বা নবায়নযোগ্য এ ধরণের জ্বালানী কেন্দ্রগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় কাজ করবে। দলটির সদস্য মুস্তফা হাসান বলেন, আমাদের এই রোবট মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পরিষ্কারের কাজগুলো করে দেবে। শুধু তাই নয়, সোলার প্লান্টে কি পরিমাণে ময়লা আছে। পরিষ্কার করার জন্য কি করতে হবে সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমাদের এই প্রযুক্তি পরিষ্কার করার খরচ কমিয়ে দেবে প্রায় ৩০ ভাগ। এই দলের সদস্য হিসেবে রয়েছেন মাহমুদুল হাসান ও ইব্রাহিম খলিল।

বুয়েটের ইলেকট্রিকাল ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের দুই শিক্ষার্থী ইশমাম হাসনাত ও সামিন জাওয়াদ এবং বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মো. মেহদী হাসান সাগর একুয়া পাওয়ার দল গঠন করেন। তিনজনই থাকেন মিরপুরে। সেখান থেকেই বন্ধুত্ব। পরীক্ষার আগের বন্ধে ফাঁকা সময়টা কাজে লাগাতে ইনোভেটিভ কিছু করার কথা ভাবছিলো তারা। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচ্ছুরণের কথা জানতে পেরে রেজিস্ট্রেশন করেন মেহদী হাসান সাগর। তিনি বলেন, প্রত্যেক বাসাতেই প্রচুর পানি ব্যবহার করা হয়। সেটা সুয়ারেজ লাইন থেকে শুরু করে নরমাল সিংক বা গোসলের পানির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমরা সেই পানির গতি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করব। বর্ষার সময় যখন সোলার প্যানেলের কার্য ক্ষমতা কমে যায়, তখন বৃষ্টির পানির গতির কারণে আমাদের এই টারবাইন ভালো কাজ করবে। সুতরাং বিকল্প শক্তি হিসেবে এটি ওয়েস্ট ওয়াটার পাইপে যুক্ত করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। আমাদের এই প্রযুক্তি উৎপাদন করতে দেশে তৈরি বিভিন্ন যন্ত্রাংশ যথেষ্ট।

ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি বিভাগের শিক্ষার্থী নিয়াজ আফনান আহমেদ ও মো. জাহিদ হাসান যৌথ উদ্যোগে তৈরি করেন আইইউটি ইনোভেটরস। সেইন্টমর্টিনের মত প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অধিক নির্ভরশীলতা রয়েছে ডিজেলের উপর। আর সে কারণেই এই এলাকায় বাতাসের গতি ও স্রোতের গতি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছে আইইউটি ইনোভেটরস। নিয়াজ আফনান বলেন, এটি প্রকৃতি বান্ধব একটি ব্যবস্থাপনা। এতে করে পরিবেশ দূষণরোধের পাশাপাশি সাশ্রয়ী ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহ রুখসানা আক্তার উর্মি ও মো. আব্দুস শুকুর ইমরান এবং তাদের শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক মাহমুদুল হাসান এবং অধ্যাপক ড. মো. মেহদী হাসান খান একত্রে কাজ করছেন ইকো পাওয়ার প্রজেক্ট নিয়ে। পাহাড়ি অঞ্চল বা প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে যেখানে বিদ্যুতের লাইন পৌঁছানো বেশ কঠিন সেখানে বৃষ্টির পানির গতি ও পানির প্রবাহকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে এই দল। শাহ রুখসানা আক্তার উর্মি জানান, আমরা টিনের চালে টার্বাইন স্থাপন করলে বৃষ্টির পানি যখন সেখানে আঘাত করবে তার গতি বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর করা হবে। প্রযুক্তিটি ব্যবহার করার জন্য খুব বেশি খরচ করা লাগবে না। দেশে উৎপাদিত উপকরণ দিয়েই এটি তৈরি সম্ভব।

বুয়েট থেকে অংশ নেয়া আরেকটি দলের নাম ইকো কুলার। দলটিতে রয়েছেন সিয়াম আলম এবং মুহাম্মদ বায়েজিদ বোস্তামি। সিয়াম আলম বলেন, প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করে বাতাসের চাপকে কাজে লাগিয়ে উষ্ণ বাতাসকে শীতল করার একটি প্রোজেক্ট নিয়ে আমরা অংশ নিয়েছি এখানে। আমরা মনে করি, বিচ্ছুরণ এমন একটি আয়োজন যেখানে নতুন নতুন আইডিয়া তৈরিতে আমাদের তরুণ সমাজকে আগ্রহী করে তোল হচ্ছে।

স্নেহাশীষ ঘোষ দ্বীপ ও নির্ঝর বড়ুয়া ‘গ্রাভিটেশনাল ওয়াটার ভারটেক্স পাওয়ার প্লান্ট’ নিয়ে এসেছে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের কাছে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দিতে। বুয়েটেরে এই দুই শিক্ষার্থী পানির প্রবাহকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তরের জন্য টার্বাইন ব্যবহার করছে। তারা জানায়, এই প্রক্রিয়া তৈরি করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু পদ্ধতি রয়েছে। এর মধ্যে ঐ এলাকার জন্য উপযোগী ব্যবস্থাটাকে গ্রহণ করে খরচ হ্রাস করা সম্ভব।

সূত্র: ইত্তেফাক

Sharing is caring!

Leave a Comment