রাহাতের নিরক্ষরমুক্ত সংগ্রাম
- মো. সাইফ
‘সেলিমের ৭ বছর বয়সী মেয়েটা প্রতিবন্ধী। কত ফুটফুটে সুন্দর শিশু। অথচ সে হাঁটতে পারে না, ঠিকমত খেতে পারে না। সেলিমের ছেলেটারও হার্টে সমস্যা। বয়স এক বছরও হয়নি এখনো। চিকিৎসা চলছে টেনেটুনে। দুই সপ্তাহ পর আবার ডাক্তারের কাছে যাবে। …স্টেশনের আরেক ছেলে শাকিল, যার দুই হাত কাটা। স্বাবলম্বী হতে চায়। পানের টঙের মালিক এখন। একটা ভ্যানের আবদার করেছে আমার কাছে।’ কথাগুলো বলছিলেন মাহফুজুর রহমান রাহাত। যাদের সম্পর্কে কথাগুলো বলছেন তারা সবাই ছিন্নমূল মানুষ। কমলাপুর রেলস্টেশনে এরা সবাই থাকে। ২০১২ সাল থেকেই মানুষগুলোর সুখে দুখে পাশে থাকছেন রাহাত।
‘স্ট্রিট চিলড্রেন ড্রিম ২০১২’ নামে যৌথভাবে একটি প্রজেক্ট শুরু করেছিলেন আলফ্রেড স্বপন বিশ্বাস এবং মাহফুজুর রহমান রাহাত। লক্ষ্য ছিল কমলাপুরের পথশিশুদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। এই কাজ করতে গিয়েই একবার তারা একটি দেড় বছরের শিশুকে কুড়িয়ে পান স্টেশন থেকে। সেই শিশুটি এক সপ্তাহ এক দেহকর্মীর কাছে পড়ে ছিল। হয়ত বড় হয়ে মেয়ে শিশুটিকেও দেহকর্মী হতে হতো। রাহাত এবং আলফ্রেড শিশুটিকে নিয়ে আসেন। টাইংগাইলে একটি পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেন। স্বপ্না নাম দেয়া সে মেয়েটি এখন পড়তে শিখেছে।
সমাজের অসংগতি নিয়ে হতাশাবাদীদের দলে নন রাহাত। তার বড় স্বপ্ন বাংলাদেশ হবে নিরক্ষরমুক্ত একটি দেশ। এই লক্ষ্যে বর্তমানে মাহফুজুর রহমান রাহাত কাজ করছেন তার স্বপ্নের প্রজেক্ট নিয়ে। যার নাম ‘অক্ষর আলোয় বাংলাদেশ।’
বঙ্গবন্ধু মেডিকেল হাসপাতালে একদিন এক ব্যাক্তিকে অনেকক্ষণ ধরে কিছু একটা খুঁজতে দেখলেন রাহাত। মানুষটি শহরে নতুন, দেখে বোঝা যায়। রাহাত কথা বলে জানলেন, ব্লক বি কোন দিকে সেটাই খুঁজছে মানুষটি। অথচ তার পাশেই বড় করে লিখা ‘ব্লক বি’। মানুষটির অক্ষরজ্ঞান থাকলে নিশ্চয়ই সে এটি নিজেই খুঁজে বের করতে পারতো। তবে তারচেয়ে ভয়াবহ যে ব্যাপারটি রাহাতের মাথায় এসেছে তা হলো, এই মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে কেউ তাকে ভুল বুঝিয়ে তার কাছে যা ছিল সব লুট করে ফেলতে পারে।
রাহাত ভাবলেন, এই বয়সের একজন মানুষের সার্টিফিকেট-ভিত্তিক পড়াশুনার দরকার নেই। যেটা দরকার সেটি হলো সাধারণ জ্ঞান। কিছু দেখে নিজে বুঝতে পারা ও লিখতে পারা। এই চিন্তা থেকেই অক্ষর আলোয় বাংলাদেশের যাত্রা শুরু।
প্রতিটি গ্রামে একটি করে বিদ্যালয় থাকবে। পড়াবে সেই গ্রামেরই কলেজ-পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। রাহাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাংকিং ডিপার্টমেন্টে পড়ছেন। তার পরিচিত বন্ধুরাই তাদের নিজ নিজ গ্রামে এই উদ্যোগটি নিবে। সার্বিক তত্ত্বাবধানে থাকবেন তিনি নিজে। প্রতিটি স্কুলের জন্য যাবতীয় সরঞ্জাম পৌঁছে দেয়া হবে ঢাকা থেকেই।
অক্ষর আলোয় বাংলাদেশের বর্তমান কার্যক্রম শুরু হয়েছে বেশ কয়েকটি জেলায়। নরসিংদী, নেত্রকোনা, ঝালকাঠি, যশোর ইত্যাদি। পর্যায়ক্রমে ছড়িয়ে দিতে চান গোটা দেশে। এর পাশাপাশি এই মানুষগুলোকে স্বাস্থ্য-সম্পর্কে সচেতন করাও তার এই প্রজেক্টের লক্ষ্য। শুধু তাই নয়, জলবায়ু সমস্যা মোকাবেলার লক্ষ্যে স্কুলের সকলকে বৃক্ষ-রোপন কর্মসূচীতে জড়িত করা হবে। রাস্তার পাশে কিংবা বাড়ির আঙ্গিনায় এই গাছগুলো রোপন করা শুরু করবেন তারা এই বর্ষায়।
ইতিমধ্যে অক্ষর আলোয় বাংলাদেশ তুমুল সাড়া ফেলেছে তার পরিচিতজনদের মাঝে। ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্সুরেন্স বিভাগের কয়েকজন শিক্ষক তার প্রকল্প নিয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন নিয়মিত এবং সার্বিক সহযোগিতা করবেন বলে জানিয়েছেন। তার সহপাঠীরা আর্থিকভাবে এবং কেউ কেউ তাকে শিক্ষা-সামগ্রী উপহার দিয়ে সাহায্য করছেন। এই ধরনের সহযোগিতা সবার থেকেই আশা করেন তিনি। এতে করে দ্রুততর সময়ের মধ্যে তিনি তার প্রজেক্টের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন বলে মনে করছেন।
রাহাত মতিঝিল মডেল স্কুল, নটরডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে পড়াশুনার সুযোগ পেয়েছেন। মতিঝিল মডেল স্কুলের থমকে যাওয়া বিতর্ক সংগঠনের নবযাত্রা শুরু করেন রাহাত। সাথে ছিলেন মহির মারুফ, প্রশান্ত কুমার সেন, রাশেদ সিদ্দিকী তূর্য। এই বিদ্যালয়ের আবুল হোসেন স্যারের অনুপ্রেরণায় তিনি প্রথম স্বপ্ন দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও বিভিন্ন ছাত্রভিত্তিক ইস্যুতে রাখছেন সক্রিয় ভূমিকা। ‘শ্রাবণ’ নামের বাসের গণযোগাযোগ সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন তিনি।
নটরডেম কলেজের নবীন-বরনের দিনে শ্রদ্ধেয় তিতাস রোজারিও স্যারের একটি কথা দিয়েই শেষ করলেন আড্ডা। ‘Don’t think you are nothing, Don’t think you are everything, you think you are something, Who can achieve everything.’ রাহাতও চান সব কিছুকে জয় করতে, তবে একা হয়ে নয়, নিরক্ষর-মুক্ত একটি দেশের সবাইকে নিয়ে।