মেহেদীর রোশনাইয়ে উজ্জ্বল রশনী
- মো. সাইফ
গণিতের শিক্ষক বোর্ডে অংক কষছেন। মেয়েটির কাজ হচ্ছে সব অংক খাতায় নোট করা। কিন্তু ক্লাস শেষে দেখা গেলো অংকের বদলে খাতার পেছন দিকটায় বাহারি ডিজাইন! ছোট বয়স থেকেই আঁকাআকির প্রতি অন্য এক টান তার। এমন খাতা খুঁজে পাওয়া মুশকিল যেখানে তিনি ডিজাইন আঁকেননি। আনমনে হুটহাট না ভেবেই করে ফেলা সেসব ডিজাইনের অভ্যাসই যে তার জীবনে একসময় ভিন্ন এক মাত্রা যোগ করবে সেটা হয়ত নিজেও ভাবেননি।
তিনি মরিয়ম বিবি রশনী। ‘ক্রিয়েটো মেহেদী আর্ট’ এর উদ্যোক্তা। খাতায় নয় এখন হাতে হাতেই ডিজাইন আঁকেন মেহেদীর রঙ্গে।
ঈদ, পুজা, বিয়ে, জন্মদিন, পহেলা বৈশাখসহ বিভিন্ন ধরনের উৎসবে অনুষ্ঠানে মেহেদীর চাহিদা রয়েছে ব্যাপক পরিমাণে। বাঙ্গালী নারীরা উৎসবে নিজেকে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে রাঙ্গাতে চান। মেহেদী তারই একটি অংশ। তবে ভালো ডিজাইনার এক্ষেত্রে খুঁজে পাওয়া কিছুটা কঠিনই। এই বিষয়কে মাথায় রেখেই রশনী তার ডিজাইন আঁকার প্রতিভাকে কাজে লাগাতে চাইলেন।
‘ক্লাস নাইন-টেনের যখন পড়ি প্রায় সব ঈদ কিংবা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিতান্তই শখের বশে পরিবারের সদস্যদের মেহেদী লাগিয়ে দিতাম। ডিজাইন পছন্দ হওয়ায় এই পরিধি বড় হতে থাকল। ক্লাসের বান্ধবী ও প্রতিবেশিদের কাছ থেকেও ডাক পেতাম মেহেদী ডিজাইন এর জন্য।’ কীভাবে ক্রিয়েটো মেহেদী আর্টের আইডিয়া এসেছে সেই প্রশ্নের উত্তরেই কথাগুলো বলছিলেন রশনী। ভালো কাজ উপহার দিয়ে প্রশংসা পেয়েছেন প্রচুর। অতঃপর বন্ধু সীমান্ত ও অন্যান্যদের অনুপ্রেরণা পেয়ে ২০১৫ সালের ২৫ এপ্রিল শুরু করেন ক্রিয়েটো মেহেদী আর্টের শুভযাত্রা।
সবসময় ব্যাক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী তিনি। একবার এক ঈদে পরিচিত এক বড় আপুর কাছে গিয়েছিলেন হাতে মেহেদী আঁকাবেন বলে। জরুরী এক ফোন আসায় সেই আপুটি অর্ধেক ডিজাইন করেই চলে যান। মন খারাপ হয় তার। মা বললেন, ‘নিজেই হাতে ডিজাইন করা শিখে ফেল। তাহলে আর কোথাও যেতে হবে না।’ তখন হাতের সামনে মেহেদী কোণ থাকলেই সেটি দিয়ে টিস্যু প্যাপার এর উপর ডিজাইন করা শুরু করতেন রশনী। ধীরে ধীরে খুব ভালো ডিজাইন আঁকা শিখে গেলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে কিছুদিন আগে সেই আপুটির বিয়েতে রশনী তার হাতে মেহেদী ডিজাইন করেন।
তার মতে,‘ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হওয়ার চেয়ে ব্যক্তি স্বাধীনতার মূল্য দিতে গিয়ে উদ্যোক্তা হতে চেয়েছি।’
গ্রাহকরা সাধারণত আগে থেকেই ফোনে অথবা ফেসবুক পেজে যোগাযোগ করে সময়-সূচি ঠিক করে নেন। এরপরই তারা রশনীর সাথে দেখা করে আঁকিয়ে নেন নিজের ইচ্ছের ডিজাইন। তবে রশনী বললেন, ক্রিয়েটোর পক্ষ থেকে হোম ডেলিভারী সার্ভিসও দেওয়া হয়। এছাড়া ‘স্পেশাল রাজস্থানি মেহেদী’ও বিক্রয় করে থাকে ক্রিয়েটো মেহেদী আর্ট। ভালোই সাড়া পাচ্ছেন এই কাজে। মূলত সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির দিকেই সাধারণত বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো হয়ে থাকে, ওই সময়টায় কাজ বেশি আসে। এছাড়া সারা বছরই বিভিন্ন প্রোগ্রামে কাজ পেয়ে থাকেন।
তার কাজে সব চেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা পান মায়ের কাছ থেকে। এছাড়া বন্ধুমহলের অবদানও কম নয়। তাদের ছাড়া এগিয়ে যাওয়া অনেক কঠিন হতো বলে মনে করেন রশনী। তবে সমাজের অনেকেই এখনো নারীদের কাজকে স্বাভাবিকভাবে দেখতে পারেন না। বেশিরভাগ সময়ই ইভেন্ট শেষ করে বাসায় ফিরতে রাত হয়, তার জন্য আশেপাশের কিছু মানুষ নেতিবাচক কথা বলেন। মেয়েমানুষ হয়ে এত রাতে বাড়ি ফেরা ঠিক নয় ইত্যাদি ইত্যাদি। রশনী আশা করেন একদিন তারাও তার কাজের জন্য গর্ববোধ করবে।
ভিকারুন্নিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি শেষ করে রশনী বর্তমানে পড়ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগে। পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিতে ভবিষ্যতে নিজে উদ্যোগী হয়ে কিছু করতে চান। ক্রিয়েটো নিয়ে তার স্বপ্ন একটি বড়সড় মেহেদী স্টুডিও দেওয়া। বিপুল সংখ্যক নারীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা। নারীদের উদ্যেশ্যে বললেন, ‘নিজের আগ্রহের বিষয়কেই সর্বোচ্চ গুরত্ব দিতে হবে, বাধা আসবেই কিন্তু নিজের উপর থাকতে হবে অগাধ বিশ্বাস তবেই সম্ভব হাসিমুখে এগিয়ে যাওয়া।’