বস্তির শিশুদের ভার্চ্যুয়াল স্কুল
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
বিকেল হতেই মহল্লার ছেলেরা ব্যাট–বল হাতে হাজির মাঠে। খেলবে ক্রিকেট। শিক্ষার্থী থেকে চাকুরে, খেলোয়াড় হিসেবে জোট বাঁধেন সবাই। মাঠে যখন তাঁদের খেলা চলে, তখন দর্শক হিসেবে জুটে যায় কিছু শিশু। এরা থাকে পাশের বস্তিতে। খেলা দেখে হাততালি দেয়। কখনো দূরে যাওয়া বল কুড়িয়ে এনে দেয় এই শিশুরা। অনেক সময় আবার খেলার সুযোগও জুটে যায় তাদের কারও কারও। ঢাকার বনশ্রীর একটা মাঠ ঘিরে এ দৃশ্য রোজকার। আর এভাবে সখ্য গড়ে ওঠে খেলোয়াড়দের সঙ্গে।
বস্তিতে অনাহার-অনাদরে বেড়ে ওঠা শিশুদের দুরবস্থার কথা জেনে ‘কিছু একটা’ তাগিদ অনুভব করেন তরুণেরা। সেটা থেকেই তাঁরা গড়ে তোলেন ‘দ্য অ্যালায়েন্স ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ নামের সংগঠন। ২০১৪ সালের কথা সেটি। সংগঠনটির সহসভাপতি আহসান মাহমুদ বললেন, ‘ওদের অক্ষরজ্ঞান পর্যন্ত ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে আমার ছোট ভাই নাফিস আউসফ প্রস্তাব করেন, আমরা ওদের লেখাপড়ার জন্য কিছু করতে পারি কি না। তারপরই সবাই মিলে আলোচনা করি আরিফুর রহমানের সঙ্গে।’ এভাবে ভিত তৈরি হয় অ্যালায়েন্স ফাউন্ডেশনের ভার্চ্যুয়াল স্কুলের।
ভার্চ্যুয়াল স্কুল
বস্তিবাসী ও পথশিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বালাতে অ্যালায়েন্সের প্রথম উদ্যোগ এই ভার্চ্যুয়াল স্কুল। প্রতি শুক্র ও শনিবার বিকেল চারটা থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত চলে পাঠদান। অক্ষরজ্ঞান থেকে শুরু করে বাংলা, ইংরেজি, সাধারণ জ্ঞান, ছবি আঁকা, গল্প কিংবা গানের আসর—সবই রয়েছে এই স্কুলটির পাঠ্যতালিকায়। স্কুল চলার সময় টিফিনের ব্যবস্থাও রয়েছে। প্রতি মাসেই শিশুদের নাচ-গান-চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। পাশাপাশি থাকে শিক্ষাসফরের ব্যবস্থা।
অ্যালায়েন্স ফাউন্ডেশনের সভাপতি আরিফুর রহমান জানালেন, শুরুতে স্কুলে আসা শিশুর সংখ্যা ছিল ১৪-১৫। এখন এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০। প্রতিটি শ্রেণিতে গড়ে সাতজনের বেশি শিক্ষার্থী পড়ছে। এই স্কুলে পড়েই সব পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে, এমন ব্যবস্থাও করে দেওয়া হয়েছে। চলতি বছর এই স্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণির জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা দেবে সাতজন। এদেরই একজন রাবেয়া। সে পড়ত দূরের আরেকটি স্কুলে। কিন্তু আসা–যাওয়ার পথে কয়েকটি বখাটে ছেলে তাকে উত্ত্যক্ত করত। এখন বাসার সামনে নিশ্চিন্তে পড়তে পারছে বলে ও অনেক খুশি।
শিশু আলাউদ্দিন। এই কদিন আগেও এখানে–ওখানে ভিক্ষে করে বেড়াত, এখন দিব্যি পড়াশোনায় মন বসিয়েছে। আলাউদ্দিন বলে, ‘আগে ভিক্ষে করতাম, তাতে টাকা পেতাম কিন্তু আদর পেতাম না। এখন আমি আদর পাই, টাকা লাগব না।’
এটাকে ভার্চ্যুয়াল স্কুল বলা হচ্ছে কেন? আরিফুর রহমানের জবাব, ‘আমরা প্রজেক্টর, মাল্টিমিডিয়ার পাশাপাশি অনলাইনেও ক্লাস নিয়ে থাকি। তাই এর নাম ভার্চ্যুয়াল স্কুল।’ ভার্চ্যুয়াল স্কুল এখন বনশ্রীর গণ্ডি পেরিয়েছে। রাজধানীর কড়াইদ ও খিলগাঁওয়ের তিনটি বস্তিতেও চালু হয়েছে এ রকম স্কুল। তবে সংগঠকদের স্বপ্ন এই স্কুলের কার্যক্রম সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া। এসব স্কুলে ক্লাস চলে সপ্তাহে দুই দিন করে।
অ্যালায়েন্স ফাউন্ডেশনের সদস্যসংখ্যা এখন প্রায় ৬০। নানা কাজে যে খরচ হয় তা তাঁরা নিজেরাই বহন করছেন। সংগঠকেরা জানান, তাঁরা মাসিক একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা চাঁদা দেন। এরপর প্রয়োজনে আরও চাঁদা দেন সদস্যরা।
বন্যার্তদের পাশে
চলতি বছরের ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উত্তরবঙ্গসহ সারা দেশের অনেক জেলার মানুষ। সে বন্যায় যখন মানুষ বিপন্ন, তখন ঢাকায় বসে থাকেননি এই সংগঠনের সদস্যরা। ইশরাত জাহান নামের এক সদস্য বলেন, ‘আমরা জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার পানিবন্দী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি। প্রায় ২০০ পরিবারকে ত্রাণ হিসেবে চিড়া, গুড়, ওরস্যালাইন, পাউরুটি ও পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি দিয়েছি।’
সচেতনতা বাড়াতে
‘প্রতি মাসে আমরা ক্যানসার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা চালাই।’ বললেন সংগঠক নাফিস আউসফ। পথশিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় মুহূর্তে চিকিৎসার ব্যবস্থাও তাঁরা করে থাকেন।
আরও যত কাজ
দেশের আট-দশটা স্কুলের মতো অ্যালায়েন্সের ভার্চ্যুয়াল স্কুলেও পালন করা হয় আমাদের জাতীয় দিবসগুলো। শহীদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে দিনটির পেছনে থাকা ইতিহাস জানানো হয় শিশুদের। আবার ঈদের মতো উৎসবে শিশুদের পোশাক উপহার দেওয়া হয়।
দ্য অ্যালায়েন্স ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ফেসবুক পেজ: www.facebook.com/AlliancesFoundationBangladesh