শিক্ষিত তরুণ যখন কৃষক
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল কিংবা বিষ মিশানোর মতো ভয়াবহ কাজ এখনো চলছে আমাদের দেশে। এর ফলে যে শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে তাই না, বরং পরিবেশও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আর এসব দূর করতে হলে লাগবে শিক্ষা। কৃষক যখন বুঝবেন বিষ মেশানোর ফল, তিনি সচেতন হবেন; উৎপাদন করবেন বিষমুক্ত ফসল। আর এমন লক্ষ্যে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করে কৃষিকাজকেই জীবিকা হিসেবে নিয়েছেন দেলোয়ার জাহান।
দেলোয়ার পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে। সেখান থেকেই অনার্সে দ্বিতীয় এবং মাস্টার্সে যৌথভাবে প্রথম হয়েছিলেন দেলোয়ার। এরপর সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে চাকরির সুযোগ পেলেও তা ফিরিয়ে দেন তিনি, কারণ তার ইচ্ছা দেশেই কিছু করবেন। এখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এমফিল করছেন যাত্রা, গম্ভীরা, গ্রামীণ মেলার মতো গ্রামীণ যোগাযোগমাধ্যমের উন্নয়ন নিয়ে। পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছেন ভেজালমুক্ত ফসল উৎপাদন কার্যক্রম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েই তিনি ভাবতেন, কীভাবে বিষমুক্ত ফসলাদি উৎপন্ন করা যায়! এরপর বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে তাদেরকে নিয়েই ২০১৩ সালে ঢাকার কাছেই মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার আমতলি গ্রামে জমি লিজ নিয়ে সবজি উৎপাদন শুরু করেন। নিজ জেলা কুষ্টিয়া ছেড়ে মানিকগঞ্জে চাষাবাদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘নিজের গ্রামে গেলে সবাই জিজ্ঞাসা করত—কবে আসছি, কবে যাব, কেন চাষ করি? এসব প্রশ্নের ভিড়ে মন দিয়ে কাজ করাই কষ্টকর হতো ওখানে।’ প্রতি সাপ্তাহিক ছুটিতে মানিকগঞ্জে গিয়ে ক্ষেতে কাজ করে থাকেন তিনি আর তার দলের সদস্যরা। তবে নদীভাঙনে সেখানে বেশি দিন থাকা সম্ভব হয়নি। পরে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা ‘হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড’ ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে জমি বর্গা দিতে রাজি হয়। আর এখন দেলোয়ার আর তার বন্ধুরা এই কাজে বেশ সাফল্যও পেয়েছেন। তাই তো গেল সেপ্টেম্বরে দলের অন্যতম সদস্য তপু রায়হান সাংবাদিকতা পেশা ছেড়ে কালীগঞ্জে আগমুন্দিয়া প্রাকৃতিক কৃষি খামারের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন।
বাংলাদেশে ফসলের ক্ষেতে প্রতি মিনিটে ৭২ কেজি ‘বিষ’ ছিটানো হয় বলে জানান দেলোয়ার জাহান। এতে মাটির যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করে যে ফসল উত্পাদন করা হচ্ছে; তা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রাকৃতিক উপায়ে কৃষিকাজ পদ্ধতিকে উত্সাহিত করছেন দেলোয়ার ও তার সঙ্গীরা।
রাজধানীতে ২৪ অক্টোবর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয় তাদের প্রাকৃতিক কৃষি হাট। প্রতি শুক্রবার রাজধানীর লালমাটিয়ার ২/৮, ব্লক-এফের ছোট একটি ঘরে এই হাট বসে। পরিচিত ফলমূল আর সবজির পাশাপাশি এখানে এমন সবজিও পাওয়া যায়, যা ঢাকাতে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
তপু রায়হান জানান, ইতোমধ্যেই অনেকেই তাদের দেখাদেখি বিষমুক্ত ফসল উত্পাদনে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। কালীগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুর ইউনিয়নের নয়টি গ্রাম, রায় গ্রাম ইউনিয়নের দুটি গ্রামে ১৫০ জন নারী ও ১০০ জন পুরুষ কৃষক এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
সবচেয়ে আশার কথা, দেলোয়ার আর তার বন্ধুদের এই কাজ দেখে এখন দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত তরুণরাও কৃষিকাজের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষি বিজ্ঞানী নাজিম উদ্দিনসহ অনেকেই সম্পৃক্ত হয়েছেন তরুণদের দলটিতে। তাদের উত্সাহ আর অনুপ্রেরণায় এই তরুণ দল আরও অনেককে অনুপ্রাণিত করবে, সকল কৃষককে সচেতন করে বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন করবে এমন প্রত্যাশাই রইল।