জান্নাত যখন উদ্যোক্তা
- উদ্যোক্তা ডেস্ক
ক্যালিফোর্নিয়ার জে পল গেটি জাদুঘর ছেড়ে হঠাত্ আপনার পরা শার্টের বুকপকেটের নকশায় যদি স্থান করে নেয় ভিনসেন্ট ভ্যান গগের বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘আইরিসেস’, তবে কি আপনি অবাক হবেন না? অথচ এমনটিই ঘটে যাচ্ছে ‘র’-এর পোশাকে। শার্টে এ বিখ্যাত চিত্রকরের চিত্রকর্ম ছাড়াও র-এর মসলিন শাড়িতে শিল্পীর রঙতুলির আঁচড়ে উঠে আসে যেন সমুদ্রের নীল জলরাশি আর সাদা রঙের ঢেউ, কখনওবা তাতে ফুটে ওঠে বর্ষার প্রথম কদমগুলো। পোশাকের সঙ্গে শিল্পকলার এ সমন্বয় ঘটাতে শুরু করেছেন এ দেশেরই কিছু তরুণ। তারা সবাই এ সময়ের নবীন শিল্পী।
র-এর উদ্যোক্তা চারুকলা অনুষদের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী জিন্নাতুন জান্নাত। গত বছরই মাত্র মাস্টার্স শেষ করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটিয়েছেন। এ সময়টা তাই ভাগ্যান্বেষণের, নিজের অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠা করার। তাই তরুণ এ শিল্পী চাকরি নিলেন একটি প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু একজন শিল্পীর যে সত্তা, তা যেন রয়ে গিয়েছিল খানিকটা অসন্তুষ্ট। কারণ অন্যের জন্য কাজ করার মানে হলো তার ইচ্ছা অনুযায়ী নিজের ভাবনাকে সাজিয়ে নেয়া। এতে করে একজন শিল্পীর ভাবনার যে নিজস্বতা, তাতেই ছেদ পড়ে। এটিই অনুভব করলেন জান্নাত। আর সে কারণেই সিদ্ধান্ত নিলেন চাকরি নয় নিজেই কিছু শুরু করবেন, এমন কিছু যাতে তার ভালোবাসা ও চিন্তার পূর্ণ প্রকাশই ঘটানো সম্ভব হবে।
শিল্পকলা নিয়েই পড়াশোনা যার, শিল্পকলাকে কাজে লাগিয়েই নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চাইবেন তিনি, এটাই তো স্বাভাবিক। এমনই ইচ্ছা ছিল জান্নাতের। এখন ভাবনার বিষয়, কীভাবে নিজের ভালো লাগার ক্ষেত্রটির সঙ্গে জীবিকার সমন্বয় ঘটানো যায়। এ সময় চাকরি ছেড়ে দেন জান্নাত, আর ঘুরে তাকান স্বাধীন ব্যবসার দিকে। র প্রতিষ্ঠা পায় তখনই।
র-এর যাত্রা শুরু ২০১৬ সালের ৩ নভেম্বর। ছবি দিয়েই এর যাত্রা। কাঠের বোর্ডে অ্যাক্রেলিক রঙ বা ধাতব পাতে অ্যাসিড ব্যবহার করে চমত্কার সব চিত্রকর্ম ফুটিয়ে তোলা হয়। জান্নাতের কাজে তার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন অন্য তরুণ চিত্রকররাও। যেমন র-এর জন্য ধাতব পাতে চিত্রকর্ম ফুটিয়ে তুলেছিলেন চারুকলার আরেক নবীন শিল্পী অনিক ভৌমিক। অন্যদিকে ধীরে ধীরে শিল্পকে অন্যান্য মাধ্যমের সাহায্য নিয়ে প্রসারিত করার ভাবনাটাও রয়ে যায় জান্নাতের মনে।
আগে থেকেই কাপড়ে আঁকিবুঁকি করতে ভালোবাসতেন জান্নাত ও তার বন্ধুরা। সবসময় যেমন আঁকছেন, তেমনিভাবে মনের খেয়ালে পোশাকেও ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন মাঝে মধ্যে। এ কাজটা তখন নিছক আনন্দের জন্যই করা হতো। জান্নাতের মনে হলো, কেমন হয় একেই যদি সবার সামনে তুলে ধরা হয়? যেমন ভাবলেন, তেমনভাবেই একসময় কাজে নেমে গেলেন তিনি। কখনো সিল্কের শাড়ি, কখনো মসলিনে শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় উঠে আসতে থাকল আস্ত বাগান বা ময়ূরের নাচ।
শাড়ি দিয়ে শুরু করলেও ধীরে ধীরে শার্টের ওপরও হাতে আঁকা ছবিগুলো উঠে আসতে শুরু করে। র-এর কাজ হয় মোহাম্মদপুরে জান্নাতের ব্যক্তিগত স্টুডিওতে। তার পর অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর সাহায্যে সেই কাজ মানুষের কাছে পৌঁছে দেন তিনি। জান্নাত জানান, র-কে নিয়ে ভবিষ্যতে এমনভাবে এগিয়ে যেতে চান, যাতে করে মানুষের প্রতিদিনের জীবনযাপনের অনুষঙ্গে নানাভাবে লেগে থাকে শিল্পীর মন থেকে প্রসূত শিল্পের ছোঁয়া।
একই সঙ্গে একজন তরুণ শিল্পী এবং উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা জান্নাত তার কাজ নিয়ে বেশ আশাবাদী। তাকে অনুপ্রাণিত করেছে তার বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা। তাদের সহায়তায় যেমন নিজ উদ্যোগে কাজে নামার প্রেরণা পেয়েছেন তিনি, তেমনই আবার নিজের কাজ নিয়ে সাড়াও পেয়েছেন ইতিবাচক।
একজন নবীন হিসেবে এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রসঙ্গে জান্নাত বলেন, শুভকাজ করতে চাইলেও আমরা মাঝে মধ্যে ভাবি যে আরো একটু সময় নিই। আরেকটু গুছিয়ে নিই। আসলে এমন করতে গেলেই দেরি হয়ে যায়। এর চেয়ে কাজে নেমে গেলেই দেখা যায় কোনোভাবে শুরুটা হয়ে যায়। শুরু করাটাই গুরুত্বপূর্ণ।
নিজ পরিচয় প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দিয়ে এ নবীন চিত্রশিল্পী জানান, চারপাশে যদি অনেকে অনেক কিছু করেও থাকে, তার পরও একজন তরুণ হিসেবে নিজের কিছু করার চেষ্টা থাকাকে সম্মান করেন তিনি। আর নিজের সেই ভাবনার বাস্তবায়নের পথে তাই উত্ফুল্ল মন নিয়ে পথ এগোচ্ছেন এ তরুণ শিল্পী ও উদ্যোক্তা।