আম্বারিন রেজা : চাকুরে থেকে উদ্যোক্তা

আম্বারিন রেজা : চাকুরে থেকে উদ্যোক্তা

  • উদ্যোক্তা ডেস্ক 

চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সিতে (সিএ) আমার পাঠ শেষ হয় ২০১২ সালে। তার আগে পড়ালেখার সময়ই বিশ্বের অন্যতম হিসাবরক্ষণ প্রতিষ্ঠান ‘আর্নেস্ট অ্যান্ড ইয়ং’-এ পরামর্শক হিসেবে কাজ শুরু করেছিলাম। সিএ শেষ করে ২০১৩ সালে যোগ দিই এনআরএমএ গ্রুপে। তত দিনে আমি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব পেয়ে গেছি। উচ্চতর ডিগ্রি, সঙ্গে ভালো চাকরি। ভালোই কাটছিল সময়। এর মধ্যে ২০১২ সালে ছোট ভাইও পড়ালেখার জন্য অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমায়। কিন্তু না, বেশি দিন এভাবে এগোল না। ২০১৩ সালের এপ্রিলে হঠাৎ করেই বাবা মারা গেলেন। দেশে ফিরতে হলো আমাকে। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে তখন মাথার ওপর অনেক বড় বড় দায়িত্ব। কী করব, কিছুই ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তবে মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, কিছু একটা করতেই হবে। যেভাবেই হোক পরিবারের হাল ধরতে হবে।

ছোট দুই ভাইবোন তখনো বয়সে অনেক ছোট। তারা যে কিছু করবে, সে সুযোগ নেই। যা করার আমাকেই করতে হবে। ঠিক করলাম, বিদেশে আর ফিরে যাব না। পরিবারের কাছাকাছি থাকতে হবে। মাঝখানে অস্ট্রেলিয়া গিয়ে সেখানকার পাট চুকিয়ে ফিরে এলাম দেশে। ভবিষ্যৎ তখনো অনিশ্চিত। পরিবারের আর্থিক অবস্থাও এমন নয় যে ব্যবসাপাতি কিছু শুরুর কথা ভাবব। অগত্যা চাকরি ছাড়া বিকল্প কিছু ভাবার সুযোগ পেলাম না।
শুরু হলো চাকরি খোঁজা। এই হাত, ওই হাত, নানা বন্ধুবান্ধবের হাত হয়ে ‘রকেট ইন্টারনেট’ নামের একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানে জমা পড়ল আমার জীবনবৃত্তান্ত। ডাক পড়ল সাক্ষাৎকারের। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ই-কমার্স ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানটি এ দেশে তাদের ব্যবসা শুরুর পরিকল্পনা করছিল। এ জন্য তারা খুঁজছিল কান্ট্রি ডিরেক্টর। অনেকের সঙ্গে আমিও সাক্ষাৎকার দিলাম। তারা আমাকে নির্বাচিত করল।

আমার কাঁধে এসে পড়ল বিশাল এক চ্যালেঞ্জ। রকেট ইন্টারনেটের হয়ে ই-কমার্স ব্যবসা চালু করতে হবে দেশে। অদম্য সাহস ছিল বুকে, ছিল পরিবারের সহায়তা। আমি একটু একটু করে এগোতে থাকলাম। আমি জানতাম, দেশে ই-কমার্স ব্যবসার কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। আমি তাদের চেয়ে ভিন্ন কিছু করতে চাইলাম। এ জন্য কোন খাতে নতুন কিছু করার সুযোগ আছে খুঁজতে শুরু করলাম। রকেট ইন্টারনেট বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ই-কমার্সের সঙ্গে জড়িত বলে ব্যবসার নতুন কিছু ক্ষেত্র সম্পর্কে ধারণা পেলাম। প্রতিষ্ঠানটি থেকেও আমাকে প্রথম পরামর্শ দেওয়া হলো ‘লামুডি’র কার্যক্রম শুরু করার।
আমি দেখলাম, এ দেশে আবাসন খাতে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্যভান্ডার নেই, যার মাধ্যমে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে একটি আস্থা রাখার মতো যোগসূত্র তৈরি হতে পারে। এবার শুরু হলো আবাসন খাতের কোম্পানিগুলোর তথ্য সংগ্রহের পালা। দিনের পর দিন বিভিন্ন আবাসন কোম্পানিতে ধরনা দিতে থাকলাম। কারও কাছ থেকে খুব ভালো সাড়া পেলাম, কারও কারও বেলায় অভিজ্ঞতাটা সুখকর ছিল না। কিন্তু আমরা পিছপা হলাম না। একটু একটু করে এগোতে থাকলাম। আবাসন খাতের যেসব কোম্পানির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি, তাঁরা আমাদের প্রস্তাবে খুবই আগ্রহ দেখালেন।

প্রাথমিক পর্যায়ে হাতে গোনা কিছু কোম্পানির তথ্য ও ছবি নিয়ে লামুডি যাত্রা শুরু করে ২০১৩ সালের নভেম্বরে। শুরু থেকেই আমাদের প্রচেষ্টা ছিল গ্রাহকের সঙ্গে বিক্রেতার যোগসূত্র তৈরি করে দেওয়া। এমনভাবে পণ্যের তথ্য ও ছবি উপস্থাপন করা হয়েছে, যাতে করে গ্রাহকের সব ধরনের চাহিদা পূরণ হয়। সাড়া খারাপ মিলল না।

দেশে ফিরতে হলো আমাকে। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে তখন মাথার ওপর অনেক বড় বড় দায়িত্ব। কী করব, কিছুই ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তবে মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, কিছু একটা করতেই হবে

এরপর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলো লামুডি। আস্তে আস্তে জনপ্রিয়তাও বাড়তে লাগল সাইটটির। লামুডি নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি আমরা ‘কারমুডি’ নামে গাড়ির বিপণনের একটি আলাদা সাইট নিয়েও কাজ শুরু করি। প্রথমে কারহাটের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে যাত্রা শুরু হয় কারমুডির। এরপর বিভিন্ন গাড়ির শোরুমে গিয়ে বিক্রেতাদের এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়। বলতে গেলে আমার তত্ত্বাবধানেই লামুডি ও কারমুডি—এই দুটি ই-কমার্স সাইটের যাত্রা। লামুডি-কারমুডির পরপরই চালু হয় ‘কেইমু’। তিনটি সাইটই কাছাকাছি সময়ে চালু হয়। তবু কেন যেন আমার ভেতরে একটা অতৃপ্তি কাজ করছিল। নতুন কিছু করার তাড়নায় আমি চাকরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিই।

এদিকে রকেট ইন্টারনেটের হয়ে তিনটি ই-কমার্স ব্যবসার যাত্রা শুরুর পর প্রতিষ্ঠানটির নির্ভরতা বেড়ে যায় আমার ওপর। তাদের পক্ষ থেকে আমাকে প্রস্তাব করা হয় ‘ফুডপান্ডা’র কার্যক্রম শুরু করার। এবারের প্রস্তাবটি ছিল ভিন্ন। বলা হলো, এবার চাকরিজীবী হিসেবে নয়, সহ-উদ্যোক্তা হিসেবে ফুডপান্ডার সঙ্গে যুক্ত হতে পারি। কোম্পানিতে আমারও মালিকানা থাকবে।প্রস্তাবটি আমারও বেশ পছন্দ হলো। তাই হাতছাড়া করলাম না। কারণ, আমি তো এমন কিছুরই পরিকল্পনা করছিলাম। কিছু বিষয় নিয়ে দর-কষাকষি শেষে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্ত হলাম ফুডপান্ডার সঙ্গে।

প্রতিষ্ঠানটির দুই বছর এখনো পূর্ণ হয়নি। এরই মধ্যে ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ও সিলেট নগরীতেও এটি এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিষয়টি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা উৎসাহিত হওয়ার মতো। ঘরে বসে আপনার বিশেষ কোনো রেস্তোরাঁর খাবার খেতে ইচ্ছে করছে? আমরা সে সুযোগটা করে দিচ্ছি। এভাবে তিনটি শহর মিলিয়ে আমাদের মাধ্যমে প্রতি মাসে এখন গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার খাবারের অর্ডার হচ্ছে। তাও আবার তিন শহরের সব জায়গায় আমরা খাবার সরবরাহ করতে পারছি না। খাবারের গুণগত মান যাতে নষ্ট না হয়, সে জন্য মূলত রেস্তোরাঁর আশপাশে তিন কিলোমিটারের মধ্যে আমরা আমাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছি। এত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দুই বছরের কম সময়ে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসায় সফল হয়ে উঠেছে। না লাভ, না লোকসান অবস্থায় আমরা পৌঁছে গেছি। নিজেদের আয়ে নিজেদের খরচ মেটাচ্ছি। কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে ফুডপান্ডায় এখন ২০০ কর্মী। আমাদের সরবরাহকেন্দ্র রয়েছে ১৪০ থেকে ১৫০টি। শুধু ঢাকা শহরের ভেতরেই রয়েছে আটটি সরবরাহ অঞ্চল।

এই যে ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এত দূর আসা, সফলতা যেমন পেয়েছি, তেমনি বন্ধুর পথও পাড়ি দিতে হয়েছে। এমনও হয়েছে বিদেশ থেকে অফিস ভাড়া, বেতন-ভাতা আসতে দেরি হয়েছে অনেক। কারণ, রকেট ইন্টারনেট ছিল একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান। তারা টাকা পাঠালেও সেই টাকা ছাড় করতে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। এ কারণে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে অফিস চালিয়েছি। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে নিজের গাড়িও বিক্রি করতে হয়েছে। এখন অবশ্য খুব বেশি সেই পরিস্থিতিতে পড়তে হয় না।

ই-কমার্স ব্যবসায় বাংলাদেশ ধীরে ধীরে অনেক উন্নতি করছে। তবু আমার মনে হয় তা সম্ভাবনার চেয়ে অনেক কম। এখনো অনলাইনে আমরা যত ক্রয়াদেশ পাই, তার বেশির ভাগই নগদে লেনদেন হয়। পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো নগদ লেনদেনে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। অথচ বিদেশে বিভিন্ন ধরনের কার্ডে লেনদেনকে অনেক বেশি উৎসাহিত করা হয়। এমনকি কার্ডে লেনদেনকে উৎসাহিত করতে মূল্যছাড়ও দেওয়া হয়। আর আমাদের দেশে ঠিক তার উল্টোটি। এটি আমার কাছে খুবই আশ্চর্যজনক লাগে। বিষয়টি নিয়ে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের কথা শুনে মনে হয়েছে, কার্ড ব্যবহারের ক্ষেত্রে খরচ বেশি। ব্যাংকগুলো বেশি মাশুল আদায় করে। এ কারণে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো কার্ডে লেনদেনের চেয়ে নগদে লেনদেন করতে বেশি আগ্রহ বোধ করে।

বর্তমানে এ দেশের, বিশেষ করে রাজধানীর মানুষের জীবনযাত্রার যে অবস্থা, তাতে আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করে মানুষের জীবনকে সহজ করে দেওয়া। বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাত, আর্থিক প্রযুক্তি নিয়ে নতুন কিছু করতে চাই। বিদ্যমান ব্যবসাকে হুমকিতে না ফেলে বরং তাদের ব্যবসার আরও প্রসার ঘটিয়ে মানুষের জীবন কীভাবে আরও সহজ করে দেওয়া যায়, সেটিই আমার স্বপ্ন।
সূত্র: প্রথম আলো  দলে দলে কাজ

Sharing is caring!

Leave a Comment