বদলে যাচ্ছে পড়ার ধরন

বদলে যাচ্ছে পড়ার ধরন

  • ক্যাম্পাস ডেস্ক

তরুণদের সময় কাটানোর অন্যতম সেরা মাধ্যম হলো বই পড়া। তরুণরা সাধারণত অ্যাডভেঞ্চার বা রহস্য গল্পের প্রতি বেশি আগ্রহী হয়। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বা হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের প্রতিও তরুণদের খুব আকর্ষিত হতে দেখা যায়। অলস দুপুর কিংবা কোনো অবসরে বই নিয়ে সময় কাটানো, বইয়ের পাতা উল্টে উল্টে গল্পের ভিতরে ডুবে যাওয়ার ব্যাপারগুলো ছিল আগেকার তরুণদের প্রবণতা। এখনকার তরুণেরাও বই বিষয়ে সেই প্রবণতা একই রকমভাবে ধরে রেখেছে। যে কারণে কাগজের পত্রিকার প্রতি নির্ভরতা কমে এলেও তরুণেরা কাগজে ছাপা বই-ই পছন্দ করছেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী তরুণেরা কাগজের বইকে পিডিএফ সংস্করণের চেয়ে এখনো বেশি এগিয়ে রেখেছে পছন্দের তালিকায়। বইয়ের পাতা ওল্টানোর সঙ্গে গল্পের এগিয়ে চলার যে অনুভূতি, তা কম্পিউটার বা স্মার্টফোনে পিডিএফ ফাইল স্ক্রল করার মধ্যে নেই। বই কতটুকু পড়া হলো বা আরও কতটুকু বাকি—পৃষ্ঠার কলেবর দেখে এটুকু বোঝার সামর্থ্য পিডিএফ ফাইল বা ই-বই দেয় না। কাগজের বইয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো চিহ্নিত বা মার্ক করে রাখতে পারার একটা সুবিধাও পাওয়া যায়। ডিজিটাল বইয়েও চিহ্নিত করার সুযোগ রয়েছে, তবে এক্ষেত্রে দাগটা মস্তিষ্কে কম, বরং যন্ত্রেই বেশি পড়ে।

হাজার হাজার বই সংরক্ষণ করা যাচ্ছে মাত্র কয়েক গিগাবাইটের মেমোরি কার্ডে। প্রয়োজন নেই আর সেই বড় বড় তাক কিংবা স্টাডি রুমের। হাজারখানেক বই হলে একজন সংগ্রাহক যেখানে হিমশিম খেতেন, এখন সেটা নিশ্চিন্তে পকেটে করে ঘোরা যায়। তাহলে কি কাগজের বইয়ের দিন শেষ?

কাগজের বই নাকি ই-বুক—বর্তমান সময়ের খুব মজাদার একটি আলোচনার বিষয়। যেখানে ব্যক্তিগত পছন্দের ওপর ভিত্তি করে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন অনেকেই।  তবে এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই, আমাদের দেশে ই-বুকের জনপ্রিয়তা কোনো অংশেই কম নয়। এর একটা কারণ হয়তো আমাদের দেশে বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হয় মূলত ছাত্রাবস্থা থেকেই। যখন একজন শিক্ষার্থী অনেক বেশি নির্ভর করেন পরিবারের ওপর। সে ক্ষেত্রে ৪০০ টাকা দিয়ে একটা বই কেনার চেয়ে কিছু মেগাবাইট খরচ করে ডাউনলোড করে নেওয়া অনেক বেশি সাশ্রয়ী। যদিও ইউরোপ কিংবা আমেরিকার মতো আমাদের দেশের প্রকাশকরা ই-বুকে এখনো ততটা অগ্রসর হতে পারেননি। আমাদের দেশে এখনো যেসব ই-বুকের বহুল প্রচলন তার অধিকাংশই বৈধ নয়। তবে এতকিছুর পরও ছাপা বইয়ের আবেদন কোনো অংশেই কম নয়।

ধরুন, আপনার প্রিয় লেখক জাফর ইকবালের সদ্য প্রকাশিত বই কিনে যদি প্রিয় লেখকের অটোগ্রাফ নিতে পারেন, তাহলে এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে। তবে মজার ব্যাপার হলো, আধুনিক ডিভাইসগুলোও ঠিক আপনাকে এমন সব আনন্দ থেকে পিছিয়ে রাখবে না। অতি সম্প্রতি অ্যাপল এমন এক পেটেন্টের জন্য আবেদন করেছে, যেখানে আপনার ডিজিটাল ডিভাইসের ওপর প্রিয় লেখকের অটোগ্রাফ সংরক্ষণ করা যাবে। অ্যামাজনের কিন্ডলে আপনাকে সুযোগ করে দেবে কাগজের বই পড়ার অনুভূতি নেওয়ার। কেননা এর ফন্ট ঠিক যেন ছাপার বইয়ের মতো। আর তাছাড়া এর নিজস্ব কোনো আলো নেই (যদিও এখন অ্যামাজেনের ব্যাকলাইট সুবিধার কিন্ডলেও পাওয়া যায়) অর্থাত্ কাগজের বইয়ের মতো আলোয় পড়তে হয়।

আমাদের দেশে কাগজের বই নিয়ে আশাবাদী হওয়ার সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো অমর একুশে গ্রন্থমেলা। ৪৫ বছর আগে মাত্র ৩২টি বই নিয়ে শুরু হওয়া এই বিপ্লব আজ রীতিমতো মহীরুহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সেদিনও হয়তো বেশি দূরে নয়, যেদিন আমাদের দেশের প্রকাশকরাও কাগজের বইয়ের পাশাপাশি ই-বুকও প্রকাশ করবেন।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর ভর করে পৃথিবী এখন দারুণ গতিতে এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। বদলে যাচ্ছে পড়াশোনার মাধ্যম ও উপাদান। একুশ শতকের এই প্রবণতার প্রবাহে আমাদেরকে ‘ডিজিটাল ডিভাইস’ গ্রহণ করতে হচ্ছে একরকম নিরুপায় হয়ে। উপকার যে আমরা পাচ্ছি না, তা নয়। তবে সনাতনী গন্ধ মন থেকে মুছে ফেলতে খানিকটা সময় লাগছে, এই আর কি!

‘আমার টান কাগজেই’

—মুঈদ রহমান

অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

শিরোনামের মধ্যেই একটা হারিয়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া ভাব বোধ করছি। কিন্তু হারায়নি, তবে হারিয়ে যাওয়ার পথে। মনের ভাব প্রকাশ করার ক্ষেত্রে পত্রপত্রিকার বিকল্প হিসেবে অনলাইন বড় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এ দুইয়ের প্রভাব নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলে থাকেন, সেক্ষেত্রে আমিও একটুখানি বলতে আগ্রহ প্রকাশ করছি। আমাদের জন্ম হলো ষাটের দশকের শুরুতে। সে হিসেবে আমাদের জীবন-অর্থনীতি-সংস্কৃতি সামন্ত এবং পুঁজিবাদ উভয় দ্বারাই প্রভাবিত। বলতে পারেন সামন্তবাদ থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণের সময়কার প্রজন্ম আমরা। আমাদের যন্ত্রণা অনেক বেশি। আমাদের কান পঞ্চ কবি, রবীন্দ্র, নজরুল, রজনীকান্ত, ডিএল রায়, অতুল প্রসাদের গান দ্বারা প্রলেপিত। সে কানে জেমস্ বা আইয়ুব বাচ্চুর গান তো একটু খটমটে লাগবেই। কিন্তু আমার পরের প্রজন্মের কাছে তা নাও হতে পারে। যাই হোক, আমার টান কাগজেই। পড়ুয়া ছেলে যাকে বলে, তেমন মানুষ আমি কোনোকালেই ছিলাম না। পত্রপত্রিকার সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক হওয়ার জন্য কিশোর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। তখন দৈনিক হিসেবে ‘ইত্তেফাক’ ও ‘সংবাদ’, রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যুভিত্তিক সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’, চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা সাপ্তাহিক ‘চিত্রালী’ এবং খেলার জগত্ নিয়ে পাক্ষিক কিংবা মাসিক ‘ক্রীড়া জগত্’। ইত্তেফাকটা বাসাতেই বরাদ্দ ছিল। সংবাদ এবং বিচিত্রা পাবলিক লাইব্রেরিতে পড়তাম। চিত্রালীটা বাসায় পড়তাম না। বাবা কখনো নিষেধ করতেন না, তবে তাঁর মুখ দেখে বুঝতে পারতাম, তিনি বিষয়টা ভালো চোখে দেখতেন না। ভাবটা এমন যে, লেখাপড়ার বারোটা বাজানো হচ্ছে। এক বন্ধু ছিল খুব করে ডিটেক্টিভ বই ‘দস্যু বনহুর’ পড়ত। তো ওর বাসায় চিত্রালী রাখা হতো। নিজের পয়সায় কেনা যদি বলেন তা হলো ক্রীড়া জগত্। অপেক্ষা করে পাওয়া আর অপেক্ষা ছাড়াই পাওয়ার মধ্যে তৃপ্তির অনেক ফারাক আছে বলে আমি মনে করি। সে সময় ঢাকা থেকে কুমিল্লায় পত্রিকা যেতে যেতে অনেক বেলা হয়ে যেত। অপেক্ষার যন্ত্রণাও আছে জানি, তারপরও পাওয়ার পর তৃপ্তিতে মনটা ভরে যেত। নতুন কাগজের গন্ধটাতেও এক ধরনের ভালোলাগা ছিল। আজকের অনলাইন আমাকে খুব একটা টানে না। আমাকে না টানলেও এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার জো নেই। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি বেড়েছে, আমাদের পেশাগত ও পারিবারিক জীবনের প্রকৃতি বদলেছে, সেখানে ভাব প্রকাশের মাধ্যমেরও পরিবর্তন ঘটবে—এটাই স্বাভাবিক। তাই শেষ কথায় এসে বলব, অর্থনৈতিক গতিশীলতার সাথে হয়তো অনলাইন যথার্থ কিন্তু প্রাণের তৃষ্ণা মেটাতে বোধকরি কাগজের দিনগুলোই যথার্থ।

‘কাগজ হাতে নিয়ে পড়ার মতো চমৎকার অনুভূতি আর হয় না’

—ডা. সৈয়দ মোনাওয়ার আলী

অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও প্রাক্তন সিভিল সার্জন

এখনকার সময়ে মানুষ নানাবিধ কাজে ব্যস্ত। আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। অথচ আগেকার মানুষ সবসময় চারপাশের খোঁজখবরের ব্যাপারে আগ্রহী ছিল। সংবাদপত্র পড়ার অভ্যাস কমে যাওয়ার মাঝেও এই ব্যাপারটি আছে। সংস্কৃতিগতভাবেই আমরা সংঘবদ্ধ হয়ে বসবাস করি। একে অপরের বিপদে আপদে পাশে দাঁড়াই, খোঁজ নিই। একইভাবে দেশ ও জাতির যেকোনো বিষয়েও আমরা খোঁজ নিই, আর সেই কাজে আমাদের প্রধান আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে ভূমিকা পালন করত সংবাদপত্র। বিচ্ছিন্নতার এই সময়ে আমরা যেমন একে অন্যের কাছ থেকে দূরে থাকি, তেমনি পত্রপত্রিকা পড়ে খবর জানতেও হয়তো সেভাবে আগ্রহবোধ করি না। আজকাল শুনি, ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে কিছু খবর আর কিছু ঘটনা নাকি ‘ভাইরাল’ হয়। খবর সরবরাহের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো নানাভাবে সামাজিকমাধ্যমে শিরোনাম লিখে লিংক দিয়ে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। চটকদার শিরোনামের কারণে কিছু খবর পাঠক পড়েন। এর বাইরে খুটিয়ে খুটিয়ে পত্রিকা পড়ার অভ্যাসটা নিশ্চয়ই আগের মতো নেই। ষাটের দশকের শেষদিকে কলেজে পড়ার সময় আমরা কলেজের কমনরুমের ডেস্কে বেঁধে রাখা পত্রিকা পড়তাম। অল্পকিছু পত্রিকা প্রকাশ হতো তখন। সেগুলো পড়ার জন্য ভিড় জমত। দেশ-বিদেশের খবর, ফুটবলের কালো মানিক পেলে বা সেসময়ের খ্যাতনামা খেলোয়াড়রা কোন খেলায় কত গোল দিলেন, বিনোদন জগতে উত্তম-সুচিত্রার নতুন কোন ছবি এলো—এসব নিয়ে আমাদের আগ্রহ থাকত। পাশাপাশি আমরা রাজনীতি ও অর্থনীতির খবরও জানার চেষ্টা করতাম। আমাদের ছাত্রজীবনে দেখেছি দু-একটা দৈনিক ছাড়া বেশিরভাগ পত্রপত্রিকাই সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক এমনকি ষান্মাসিক আকারেও প্রকাশিত হতো। এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে অসংখ্য গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অর্ধশত টেলিভিশন চ্যানেল, দৈনিক পত্রিকা, অনলাইন মাধ্যম—কোনটা রেখে কোনটা নেবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়াই কঠিন এই সময়ের মানুষের জন্য। পুরো প্রেক্ষাপটটাই বদলে গেছে। গতিশীলতা বেড়েছে সত্যি, কিন্তু বদলে গেছে আমাদের অভ্যাস। তবু আমি মনে করি, কাগজ হাতে নিয়ে পড়া, ছাপা অক্ষরগুলোকে স্পর্শ করা, কাগজের ঘ্রাণ নিতে নিতে দেশবিদেশের খবর জানার মতো চমত্কার অনুভূতি আর হয় না।

‘প্রিন্ট পত্রিকার দাবি কখনো ফুরাবে না’

—অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার

চেয়ারম্যান, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ

আমাদের ছোটবেলায় পত্রিকা পড়াকে সত্ গুণ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। প্রতিযোগিতামূলক বিষয়ের তথ্য জানতে, গতকালের আপডেট সংবাদ জানতে আমরা পত্রিকা পড়তাম। শুরুর দিকে জ্ঞান অর্জন করার জন্যই আমি পত্রিকা পড়তাম। পত্রিকা শুধু জ্ঞান অর্জনে সহায়ক নয়, পত্রিকা পাঠ্যভ্যাস গড়ে তুলতেও অনেক বেশি ভূমিকা রাখে। অন্তত আমার বেলায় এমনটা হয়েছে। পত্রিকা পড়ার কারণে বই পড়ার আগ্রহ বেড়েছে।

প্রযুক্তির এ যুগে প্রিন্ট পত্রিকার পাশাপাশি অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোও বেশ জনপ্রিয়। ঘটনা ঘটার সাথে সাথেই সংবাদ আপডেট দেয় অনলাইন। প্রথম দিকে অনলাইনের প্রতি আমারও আগ্রহ ছিল। অনলাইনে নিদির্ষ্ট নিয়ম মেনে পড়া যায় না। অনলাইনে পাঠকের মন স্থির থাকে না, একটা নিউজ পড়তে পড়তে অন্য নিউজে চলে যায়। ফলে ফোকাস বিষয়ে পড়া শেষ করতে অনেক সময় লাগে। অনলাইনে নিউজ পড়ে পরে অনেক সময় প্রয়োজনীয় সংবাদ লিংকটি খুঁজে পাওয়া যায় না। তাছাড়া অনলাইনে দীর্ঘ সময় সংবাদ পড়া চোখের জন্য ক্ষতিকর। মোবাইল অনলাইনে পড়া আরও বেশি ক্ষতিকর।

আমি তাই পত্রিকার প্রতি ভরসা করি বেশি। প্রতিদিন সকালে পত্রিকা পড়ার মাধ্যমে আমার দিন শুরু হয়। এক ঘণ্টা পত্রিকা পড়তে পড়তে নাস্তা সেরে নিই। পড়ে নিই জাতীয় ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো। প্রয়োজনীয় সংবাদের কাটিং রেখে দিই। রাতেও ঘুমানোর আগে সংবাদপত্রে চোখ বুলিয়ে নিই। নতুন প্রযুক্তির কারণে মানুষের কাছে কখনো সংবাদপত্রের গুরুত্ব কমবে বলে আমি মনে করি না। হয়তো সাময়িক সময়ের জন্য পরিবর্তন হতে পারে, তবে সংবাদ পত্রের দাবি সবসময় থাকবে। প্রিন্ট পত্রিকার দাবি পাঠকের কাছে কখনো ফুরাবে না।

‘নির্ভরশীল সঠিক তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে কাগজের খবরই মূল চাহিদা’

—মোহাম্মদ আলী খান

ব্যবসায়ী

খবরের কাগজ কিংবা সংবাদপত্র আমার কাছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিচ্ছবি। রাজনৈতিক, সামাজিক, আন্তর্জাতিক সব দিকের খবরই উঠে আসে সংবাদপত্রের মাধ্যমে। খবরের কাগজ পড়া আমার প্রতিদিনের একটা অভ্যাস। সকালের খবরের কাগজ দেশের একটি প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে আমাদের সামনে। জানার সুযোগ করে দেয় চলমান বিষয় নিয়ে কে কী ভাবছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার দর থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের চাষাবাদের খবর, কিছুই বাদ যায় না খবরের কাগজে। প্রতিদিন টেলিভিশন চ্যানেল কিংবা অন্যান্য মাধ্যম থেকে যে সকল খবর শুনতে পাই, এগুলো কখনোই তেমন একটা বিশ্লেষণধর্মী থাকে না। এজন্যই আসলে খবরের কাগজের ওপর নির্ভর করতে হয়।

অনেক আগে থেকেই সংবাদপত্র পড়ি। একসময় চাকরির বিজ্ঞপ্তির জন্য খবরের কাগজ প্রতিদিন পড়াই লাগত। ধীরে ধীরে তা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সারাদিন অনেকভাবেই অনেক খবর শুনতে পাই। তবে আমাদের মতো যারা খবরের কাগজ পড়ে অভ্যস্ত, তাদের কাছে যেকোনো খবরের বিস্তারিত জানাটা যেমন একটি চাহিদা, তেমনি খবরটি কতটা সত্য কিংবা বিশ্বাসযোগ্য তা জানাটাও একটি চাহিদা। আর এই চাহিদা থেকেই প্রতিদিনের খবরের কাগজ পড়া হয়। বই কিংবা খবরের কাগজ যেটাই হোক না কেন, আমার মতে পড়ার অভ্যাস থাকাটা অনেক জরুরি। আমার ক্ষেত্রে সকালের সময়টা কাটে খবরের কাগজ পড়েই। কেননা, খবরের কাগজে যে শুধু এক শ্রেণি পেশার মানুষেরই মনোভাব জানা যায়, তা না। লেখকদের সাথে সাথে পাঠকদের মতামতও জানা যায় শুধুমাত্র খবরের কাগজ থেকেই।

‘ভার্চুয়াল দুনিয়া অগ্রগামী জীবন এনে দিয়েছে’ 

—নিয়াজ মাহমুদ সজীব

শিক্ষার্থী, ফিন্যান্স বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

দিন বদলের নিরন্তর চেষ্টায় পৃথিবীর সকল মানুষ পেয়েছে আধুনিকতার স্পর্শ। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই আধুনিকায়নের সাথে আরও বেশি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছে। যার এক চাক্ষুষ উদাহরণ হলো অনলাইন নামক একটি ভার্চুয়াল জগত্। এই অনলাইন বা ইন্টারনেটের জগতে বর্তমান প্রজন্মের নির্ভরশীলতা সবচেয়ে বেশি। দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটা কাজেই রয়েছে অনলাইনের প্রয়োজনীয়তা।

একবিংশ শতাব্দীতেই বিভিন্ন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে যোগাযোগের কাজটি সহজ হতে থাকে। বিংশ শতাব্দীর শেষের দশকেও যোগাযোগের জন্য সবাই চিঠি বা টেলিফোন ব্যবহার করত। কিন্তু বর্তমানে অনলাইনে থেকেই সেকেন্ডের মধ্যে দূরদূরান্তের মানুষের সাথে কথা বলা সম্ভব হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের আড্ডার এক অন্যতম জগত্ এই অনলাইন। অনলাইনে বিভিন্ন সামাজিকমাধ্যমে বন্ধুুদের সাথে খোশগল্পে মেতে ওঠে বর্তমান সময়ের তরুণেরা। অবসর সময়ে অনলাইনে স্ক্রল করতে করতে কখন যে সময় কেটে যায় তা বোঝা মুশকিল।

এছাড়া সর্বস্তরের মানুষের জ্ঞানের পরিধি বিস্তারে সহায়ক এই মাধ্যমটির প্রতি সবার নির্ভরতা অনেক বেশি। ছেলে-মেয়েরা তাদের পাঠ্যপুস্তকের জটিল সমাধানগুলো অনলাইনের মাধ্যমে সহজে পেয়ে যাচ্ছে। দিন দিন শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন ওয়েবসাইটের সংখ্যাও বাড়ছে। ঘরে বসে অনলাইনে বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেদের ঝালিয়ে নিতে পারছে শিক্ষার্থীরা। বলা যেতে পারে, অনলাইন আধুনিক যুগের ভার্চুয়াল শিক্ষক। বলাই বাহুল্য, এখন আমাদের সব পরীক্ষার ফলাফল অনলাইনেই পাওয়া যায়। আগামীতে আমাদের আরও বেশি অনলাইন নির্ভর হতে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রতিদিন সকালে চায়ে চুমুক দিয়ে খবরের কাগজ পড়ার অভ্যাসটিও এখন প্রায় বিলুপ্ত। সকালে খবরের কাগজে ছাপানো খবরটি আগের দিন রাতেই মানুষ জেনে যায়। আর তা এই অনলাইনের মাধ্যমেই সম্ভব হচ্ছে। টেলিভিশনের বুলেটিন দেখেও যখন সম্পূর্ণ খবরটি দেখার আকাঙ্ক্ষা থেকে যায় তখন একমাত্র অবলম্বন হয় অনলাইন। সেই মুহূর্তেই অনলাইনের বিস্তারিত খবর জানা যায়। এমনকি ভিডিওসহ পুরো ঘটনা দেখতে পারে সবাই। অনলাইন বা এই ভার্চুয়াল দুনিয়াটি আমাদের জীবনে এনে দিয়েছে এক অতুলনীয় মাত্রা। আগামী প্রজন্মের কাছে অনলাইন আরও বেশি কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে এটিই আমাদের প্রত্যাশা।

‘ডিজিটালাইজেশন নিঃসন্দেহে এই শতকের বড় আশীর্বাদ’

—মাহবুবুর রহমান তাহমীদ

শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় 

সকালবেলা ঘুম ভাঙার পরে প্রথম সঙ্গী হয় মোবাইল ফোন। বালিশের পাশেই রাখা থাকে, অ্যালার্ম নামক ফাংশনটা ঘুম ভাঙায়। অ্যালার্ম অফ করে ওয়াইফাইটা অন করে মোবাইলে ডাউনলোড করা পত্রিকার অ্যাপসগুলোতে ঢুকে, কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করি। সকালবেলা তাড়া থাকলে অনেকসময় খবরগুলো পড়ার সুযোগ হয় না, সেক্ষেত্রে আছে বুকমার্ক নামের চমত্কার একটি অপশন। বুকমার্ক করে যেকোনো খবর পরে সুবিধামতো সময়ে পড়ার জন্য সংরক্ষণ করে রাখা যায়! স্কুল-কলেজে থাকতে পত্রিকা পড়ার খুব অভ্যাস ছিল। প্রতিদিনের রুটিনে একটা টাইম ঠিক করে রাখতাম এজন্য। স্কুলের পাশেই ছিল পাবলিক লাইব্রেরি। সেখানে নানা ধরনের সংবাদপত্র রাখা হতো। কোনো পত্রিকার খেলার পাতা ভালো লাগত, আবার কোনো পত্রিকার আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পর থেকে ব্যস্ত সময় শুরু হয়ে গেল, একইসাথে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে আগ্রহ বেড়ে গেল। এখন আর আগের মতো রুটিন করে পত্রিকা পড়া হয় না, অবসর সময় পেলেই অ্যাপসগুলোতে ঢুকে খবর পড়ি। অনলাইনে পত্রিকার ওয়েবসাইটগুলোতে ঢুকি, পছন্দের বিষয়গুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি করি। ডিজিটালাইজেশানের ফলে পত্রিগুলোর মধ্যে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। সংবাদ হয়েছে সহজলভ্য। কোনো ঘটনা সম্পর্কে যেকোনো আপডেট আমরা মুহূর্তেই পেয়ে যেতে পারি, পরদিন ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। আন্তর্জাতিক স্বনামধন্য পত্রিকাগুলোর রয়েছে ভালো ভালো অ্যাপ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খ্যাতিমান লেখকদের বিশ্লেষণধর্মী লেখাগুলো খুব সহজেই পড়তে পারি। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সহজেই বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে পারি। সংবাদপত্রের এই ডিজিটালাইজেশন নিঃসন্দেহে এই শতকের অন্যতম বড় আশীর্বাদ। তবে আশীর্বাদ যখন আসে, সে সাথে অভিশাপও নিয়ে আসে! ভালো ভালো পত্রিকাগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অশ্লীল এবং গুজব ছড়ানো অনলাইন পত্রিকাগুলোর দৌরাত্ম্য। সোশ্যাল মিডিয়ার একটা বড় অংশজুড়ে থাকে নানারকম আজেবাজে খবর ও গুজব। আমাদের মধ্যে খারাপ জিনিসটাকে সহজে বরণ করে নেওয়ার প্রবণতা খুব বেশি, বিশেষ করে অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে! ফলে এই সমস্ত অনলাইন পোর্টালগুলো খুব সহজেই জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়! একইসাথে কিছু অনলাইন পত্রিকার বানানো মনগড়া সংবাদ আমাদের খুব সহজেই বিভ্রান্ত করে, অনেকসময় যার ফল খুবই খারাপ হতে পারে! কাজেই আমাদের অনলাইন পত্রিকা পড়ার ব্যাপারে একটু সাবধানী হওয়া উচিত। কোনো সংবেদনশীল সংবাদ পড়ে প্রতিক্রিয়া করার আগে অবশ্যই জেনে নেওয়া উচিত তার সত্যতা!

‘উন্মোচিত হচ্ছে নতুন সম্ভাবনার দ্বার’

—মাহবুবুর রহমান

সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

দিন যত গড়াচ্ছে ,তথ্য-প্রযুক্তি ততই সমৃদ্ধ হচ্ছে। ক্রমেই মানুষের জীবন হয়ে উঠছে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময়। মানুষের হাতের নাগালে পৌঁছে গেছে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট। ইন্টারনেটের এই অবাধ সাম্রাজ্যের সুষ্ঠু ব্যবহার করে তরুণরাই তুলনামূলক বেশি উপকৃত হচ্ছে। তরুণ শিক্ষার্থীরা পছন্দমতো বিভিন্ন বিষয়ে অনলাইন কোর্স, লাইভ ক্লাস এবং ইউটিউবে বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা করতে পারছে। পৃথিবীর নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্কলারশিপ, ইয়ুথ সামিট, ছায়া জাতিসংঘ সম্মেলন, উদ্যোক্তা সম্মেলন ইত্যাদি সম্পর্কে আপডেট তথ্য পেয়ে সময়মতো আবেদন করতে পারছে। এছাড়াও দেশে বিদেশে বিভিন্ন সময়ে আয়োজিত বিতর্ক প্রতিযোগিতা, আইডিয়া জেনারেটিং কম্পিটিশন, অলিম্পিয়াড ইত্যাদি আয়োজন করা হয়—এগুলো জানার সবচেয়ে সহজতর উপায় হলো সোশ্যাল মিডিয়া।

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের যুবকদের বৃহত্ একটি অংশ বেকার। তাদের কিছু সংখ্যক চাকরির আশায় বসে না থেকে বেছে নিয়েছে আউটসোর্সিং, ফ্রিল্যান্সিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, ইউটিউবিংয়ের মত পথ। চাকরিপ্রত্যাশীরা নিশ্চিন্তে অনলাইন আবেদন ও প্রবেশপত্র উত্তোলন করতে পারছে। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে দেশে বিদেশে ছড়িয়ে থাকা বন্ধুদের সাথে পর্যাপ্ত যোগাযোগ হচ্ছে। আজকের এই মুক্ত তথ্য প্রবাহে মুহূর্তের মধ্যেই যেকোনো ঘটনা সচিত্র ছড়িয়ে পড়ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। সহজলভ্যতার কারণে তরুণরা ক্রমশ অনলাইনের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে। অনলাইন জগতের এত জয়জয়কার থাকলেও প্রযুক্তি সম্পর্কে যথাযথ শিক্ষা না থাকার কারণে শিশুরা এর অপব্যবহার করছে। পর্নোগ্রাফির প্রতি আসক্তি, জঙ্গিবাদের ফাঁদে পা, পড়াশোনায় অমনোযোগিতা, সময় নষ্ট করা, হতাশা ইত্যাদি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এসব নেতিবাচক দিক থেকে আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করার জন্য চাই সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়ন। তাহলেই কেবল ইতিবাচক দিকগুলো দৃষ্টিগোচর হবে নতুন প্রজন্মের চোখে। উন্মোচিত হবে নতুন সম্ভাবনার দ্বার।

‘ডিজিটাল লাইব্রেরির কারণে যেকোনো তথ্য মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই পাওয়া যাচ্ছে’

—মোশাররফ হোসেন, 

মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজম ডিপার্টমেন্ট, ইউল্যাব

বর্তমান সময়ে প্রায় সবার হাতে হাতেই চলে এসেছে স্মার্টফোন। আর সিম অপারেটরদের বদৌলতে ইন্টারনেট এখন খুবই সহজলভ্য। খুব কম খরচেই ইন্টারনেটের সুবিধা পাচ্ছে সবাই। আবারসব থেকে দ্রুততার সাথে বা কম সময়ে খবর শুধুমাত্র অনলাইন পোর্টালগুলোই দিতে পারে। যা অন্যান্য পত্রিকা দিয়ে থাকে পরের দিন। একারণেই অনলাইন পোর্টাল বেশি পড়া হয়ে থাকে।

এখন বই বা খবরের কাগজের সহজলভ্যতা ইন্টারনেটেই বেশি। পাঠক যেকোনো জায়গা থেকে যেকোনো সময় যেকোনো বই বা পত্রিকা বের করে কিংবা ডাউনলোড করে ফোনেই পড়তে পারছে, যেটা কাগজের বই কিংবা খবরের কাগজের ক্ষেত্রে সবসময় সম্ভব না। তাছাড়া ডিজিটাল হওয়ায় পছন্দমতো অংশগুলো পরবর্তীতে পড়ার জন্য সেভ করে রাখার সুবিধা থাকছে। ইন্টারনেট এখন এর ব্যবহারকারীদের বিশাল ডিজিটাল লাইব্রেরি ব্যবহারের সুবিধা দিচ্ছে। যেখানে আমরা যেকোনো সময় যেকোনো তথ্য মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানেই বের করতে পারছি সার্চ ইঞ্জিনের সাহায্যে। কাগজের পত্রিকা, বই ইত্যাদির ক্ষেত্রে যা কোনোভাবেই চিন্তা করা যায় না।

সূত্র: ইত্তেফাক

Sharing is caring!

Leave a Comment