দেশের প্রথম ফ্লিপড ক্লাসরুম

দেশের প্রথম ফ্লিপড ক্লাসরুম

ক্যাম্পাস ডেস্ক

দেশে এই প্রথম শুরু হলো শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক বহুমাত্রিক সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রযুক্তিনির্ভর ফ্লিপড ক্লাসরুম। ক্লাসরুমের ধারণা আর সীমিত গণ্ডির ভেতরে নেই, এখন তা স্কুলের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে চলে গেছে বাড়ি ও অনেকটা প্রকৃতির সান্নিধ্যে। আমরা শিক্ষার্থীর নিকট প্রায়ই শুনে থাকি আমার পড়তে আর ভালো লাগছে না। এ রকম কান্ত অবসন্ন মুহূর্তে তারা প্রযুক্তি ও আনন্দের মাধ্যমে আবার শিখন পরিবেশে ফিরে যেতে পারে। একঘেঁয়েমি ভাব থেকে সে ফিরে আসতে পারে আনন্দঘন পরিবেশে। এমনই একটি ক্লাসরুম পর্যবেক্ষণ হিসেবে দেশের ৪টি জেলার ৪টি স্কুলকে এর আওতাভুক্ত করে শুরু হয়েছে। মোবাইলকে এখন আর শুধু যোগাযোগের মাধ্যমই নয়, শিক্ষার উপকরণ হিসেবে দেখছেন শিক্ষা চিন্তাবিদগণ। এটুআই ও টিটিসি ঢাকা যৌথভাবে পরিচালিত করছে এই ফ্লিপড ক্লাসরুম। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ হিসেবে দেশের চারটি স্কুলকে বাছাই করা হয়েছে এ কার্যক্রমের জন্য। এর মাধ্যমে সনাতনী ক্লাসরুমের ধারণা পাল্টে যাবে বলে ধারণা করছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞগণ।

মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি আগ্রহী ও অনুসন্ধিত্সু করে তোলাই হচ্ছে এই কর্মের মূল লক্ষ্য। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও মানিকগঞ্জ এই চার জেলার চারটি বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা, তাদের বিজ্ঞান শিক্ষক ও অভিভাবকদের নিয়ে পরিচালিত এই প্রকল্পটি প্রচলিত শিখন-শেখানোর ধারণাকে সম্পূর্ণ বদলে দিতে পারে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান বিষয়ের প্রায় পঞ্চাশটি বিষয়বস্তুর ওপর শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক  ভিডিও ক্লিপ এরইমধ্যে দেশের সেরা কনটেন্ট ডেভেলপাররা প্রণয়ন করেছেন। নির্বাচিত বিদ্যালয়সমূহে এই শিক্ষা উপকরণগুলো শিক্ষার্থীদের শিখন-শেখানোর কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।

শিখন-শেখানোর প্রচলিত ধারণা হলো, শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে বিষয়বস্তু সম্পর্কিত তথ্য পরিবেশন করেন, আর শিক্ষার্থীরা শিক্ষণীয় বিষয়বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে। শিক্ষার্থীরা কতটুকু শিখলো শিক্ষক তা মূল্যায়নের মাধ্যমে যাচাই করেন। প্রয়োজনে বাড়ির কাজ, শ্রেণি অভীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট ইত্যাদি দেন। ফ্লিপড ক্লাসরুমের ধারণায়, শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষের বাইরে বিষয়বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করবে এবং শ্রেণিকক্ষে তাদের এ নবলব্ধ জ্ঞানের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটবে। উচ্চতর দক্ষতা বিকাশের মাধ্যমে তারা এ জ্ঞান প্রয়োগ করবে। নতুন কোনো বিষয়বস্তু শ্রেণিতে পড়ানোর আগেই শিক্ষার্থীকে তার গঠন সামগ্রী, অডিও বা ভিডিও সামগ্রী হিসেবে শ্রেণিকক্ষের বাইরে বাড়িতে পড়তে, দেখতে বা পর্যবেক্ষণ করতে দেওয়া হবে। এরপর শ্রেণিকক্ষে এ বিষয় সম্পর্কিত জ্ঞান আত্মীকরণে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের সহায়তা করবেন। প্রচলিত শিখন-শেখানো কলাকৌশলের পরিবর্তে শ্রেণিতে বিষয়বস্তু পড়ানোর পূর্বেই শিক্ষার্থীকে বাড়ির কাজ দেওয়া হবে। শ্রেণিকক্ষের বাইরে বাড়িতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের প্রণীত শিখন সামগ্রী নিয়ে কাজ করবে। অডিও বা ভিডিও সামগ্রী এসডি কার্ডের মাধ্যমে শিক্ষক ও অভিভাবকের সহযোগিতায় শিক্ষার্থীদের পূর্বেই সরবরাহ করা হবে। যেগুলো সাধারণ মোবাইল ফোন, স্মার্ট ফোন, ট্যাবলয়েট বা পিসিতে চলবে। এতে শিক্ষার্থীদের জন্য থাকবে সুস্পষ্ট নির্দেশনা। তারা কী কী পর্যবেক্ষণ করবে, পর্যবেক্ষণ থেকে তাদের মনে কোনো প্রশ্ন বা অনুসন্ধিত্সু জেগেছে কি-না তা লিখে আনার সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকবে। শ্রেণিকক্ষে বিষয়বস্তু সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের পূর্ব জ্ঞান নিশ্চিত করার জন্যই এই আয়োজন।

প্রচলিত শিখন-শেখানো কলাকৌশলের ধারণা পাল্টে দিয়ে প্রথমেই বাড়ির কাজ দিয়ে শুরু হওয়া নতুন পাঠকে কীভাবে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে পরিচালনা করবেন সেজন্য টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকবৃন্দ নির্বাচিত ৪টি বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষকদের বিদ্যালয় পরিদর্শনকালে প্রশিক্ষণ দেবেন। শ্রেণিকক্ষে একটি নমনীয় শিখন পরিবেশ নিশ্চিত করে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় শিখনে শিক্ষক অংশগ্রহণ করাবেন। সক্রিয় শিখনে শিক্ষক অংশগ্রহণ করাবেন। সক্রিয় শিখনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্চতর দক্ষতার বিকাশ ঘটবে। সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে তাদের বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ ও মূল্যায়ন ক্ষমতার বিকাশ ঘটবে। এ কৌশলের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের শিখন মুড উন্মুক্ত হবে। শিক্ষক তার প্রণয়নকৃত শিখন সামগ্রী শিক্ষার্থীদের ব্যবহারের জন্য অনলাইন বা অফলাইনে দিয়ে দেবেন। এ পর্যায়ে শিক্ষক কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের পাঠ সংশ্লিষ্ট পোর্টাল, ওয়েবসাইট বা ওয়েবপেইজ প্রণয়ন করবেন।

ফ্লিপড ক্লাসরুম কৌশলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয় দলের দায়িত্ব বেড়ে যাবে। এখানে শিক্ষকের একক বৃক্ততার চেয়ে পাঠে শিক্ষার্থীকে সহায়তা করাই মুখ্য। এজন্যে কলাকৌশল হিসেবে কুইজ, বিতর্ক, প্রকল্প, সমস্যা সমাধান, পরীক্ষণ, উপস্থাপন, ভূমিকাভিনয়, ব্লগিং, অনলাইন ডিসকাশন ইত্যাদি ব্যবহার করতে পারবেন। এর ফলে শিক্ষার্থীরা তাদের নিজেস্ব গতিতে শিখতে পারবে। কোনো শিক্ষার্থী শ্রেণিতে অনুপস্থিত বা অসুস্থ থাকলেও তাদের জন্য শিক্ষক নির্মিত শিখন সামগ্রী আগে থেকেই প্রস্তুত থাকবে। বাবা-মা বা অভিভাবকগণও এই শিখন সামগ্রীগুলো দেখতে পারবেন এবং তাদেরকে শিখনে সাহায্য করতে পারবেন। এখানে বাড়ির কাজের কোনো বোঝা থাকবে না। এটি সে আনন্দের সহিত দেখতে ও শুনেতে পারবে। অজানাকে জানার এক অদম্য কৌতুহল ও উত্সাহ নিয়ে শ্রেণিপাঠের আগেই তারা বিষয়বস্তু সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করবে। আর শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে বিজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে কাজের পরিবর্তে পরিচালক হিসেবে কাজ করবেন।

তিনি শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিষয়বস্তু অনুশীলনে অধিত সময় ও শিক্ষার্থীদের আচরণ নিয়ন্ত্রণে শ্রেণি ব্যবস্থাপনায় কম সময় ব্যয় করতে হবে। শ্রেণিকক্ষে তিনি একক শিক্ষার্থীকে বা ছোট ছোট শিক্ষার্থী দলের প্রতি যত্ন নিতে পারবেন। শিক্ষক তার শিখন সামগ্রী প্রস্তুতিতেও শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান বিষয়ের প্রতি আগ্রহী ও মনোযোগী করে তোলা এবং তাদের অনুসন্ধিত্সু, সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা বৃদ্ধির সুযোগ প্রদানের জন্য, তথা গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ফ্লিপড ক্লাসরুম শিক্ষকের কাছে এক অনন্য শিখন-শেখানো কৌশল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

সূত্র: ইত্তেফাকfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment