তিন তরুণীর রঙের দুনিয়া

তিন তরুণীর রঙের দুনিয়া

  • উদ্যোক্তা ডেস্ক

রংই তাদের আনন্দ। রঙের মাঝেই বসবাস। নেশাটাই যখন পেশায় পরিণত হয়, জীবনের আনন্দ বেড়ে যায় কয়েক গুণ। ফেসবুকের বিভিন্ন পেজে এই শিল্পীদের খুঁজে পাওয়া যায়। ক্যানভাসে ছবি আঁকা ছাড়াও রং করছেন টি-শার্টে, ফোনের কাভারে, কুর্তায় এমনকি জুতার ওপরেও। অনলাইন, প্রদর্শনীর মাধ্যমেই বিক্রি করছেন এসব পণ্য। ভিন্ন এই পেশায় মেয়েরা বেশ দাপটের সঙ্গেই এগিয়ে আছেন। তেমনই তিনজন নারীর গল্প।


সারা রাত ধরে কাজ করেছেন। সকালে তাই একটু দেরিতেই ঘুম থেকে ওঠা হয়েছে। হাজির হলাম জাকিয়া বিনতে ওয়াহাবের বাসায়। সাদা শার্টের সঙ্গে জিনস পরা। রঙের ব্যবহার যে সুযোগ পেলেই করেন শার্টটা দেখে বোঝা গেল। তুলির রং মোছার জন্য শার্টটা ব্যবহার করেছিলেন তিনি। ফলাফল বেশ ফ্যাশনেবলভাবেই এসেছে। যে টেবিলটায় বসে কাজ করেন তার পাশের দেয়ালটাও পুরোটাই আঁকা। কোথাও লেখা মনের কথা, কোথাও আঁকা পছন্দের নানা কিছু। কোনো এক রাতে বসে বসে এঁকেছেন। পড়ছেন শান্ত মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাশন ডিজাইন অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগে। আঁকাআঁকির প্রতি ভালোবাসা ছোটবেলা থেকেই। কাজ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মানুষের পছন্দ নিয়ে কাজ করি। আমার পছন্দমতো রং করা কোনো কিছু যে আরেকজন পছন্দ করবে এমন নয়। আমি হয়তো দুই পায়ে জুতার দুই পাটিতে দুই রকম নকশা করি, অনেকে অবাক হয়ে যায়। আমাকে কেউ যখন কাজের ফরমাশ দেয়, তাদের পছন্দের সঙ্গে মিলিয়ে কাজটা করে দিই।’

জাকিয়া প্রথম থেকেই গতানুগতিক ধারার বাইরে কাজ করতে চেয়েছেন। মুঠোফোনের কাভারে ক্রেতার পছন্দমাফিক ছবি আঁকা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তবে অন্য জিনিসের ওপরে করা কাজও বেশ প্রশংসিত হয়েছে। তালিকায় আছে হেলমেট, দোতারা, দেয়াল, ফ্যান, সিডি ইত্যাদি। ক্যানভাস তো আছেই। রঙের এই যাত্রায় কাজ শিখতে হয়েছে অনেক। প্রথম দিকে তো রংগুলো বসতেই চাচ্ছিল না। ধীরে ধীরে রং টেকসই করার পদ্ধতি বুঝে গেছেন। অ্যাক্রিলিক নিয়ে কাজ করতেই বেশি পছন্দ করেন। জাকিয়া মনে করেন রঙের ব্যবহারটা সম্পূর্ণ নিজের ওপর। একটা রঙের সঙ্গে আরেকটা রং মেশানো, নতুন রং পাওয়া খুব ভালো লাগে তাঁর। ফেসবুকের হিজিবিজি পেজে তার আঁকা জিনিসগুলো পেয়ে যাবেন। এই নামটার পেছনের কারণটাও যথার্থ। জাকিয়া একটু এলোমেলোভাবে থাকতেই পছন্দ করেন। কষ্ট হলেও একাই নিজের কাজটা করতে চান। ছোটবেলা থেকে বাবার চাকরির সুবাদে ঘোরা হয়েছে অনেক। ঘুরতে এখনো অনেক পছন্দ করেন। নানা জায়গা, নানা মানুষ, তাদের চরিত্রগুলো নতুন গল্প আঁকার প্রেরণা দেয়।

প্রিটি শিটির সারিয়া
abad5dddce1a221842fc2b76e61e21eb-untitled-21অ্যাক্রিলিক নিয়ে কাজ করতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন সারিয়া সাওয়ারো। হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলেন অ্যাক্রিলিক রং ব্যবহারের কারণে ত্বকে সমস্যা হচ্ছে। তাই বলে তো আর রং করা বন্ধ করে দেওয়া যায় না। বেছে নিলেন জলরং ও গোয়াশ পেইন্ট। রং করার অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই। মাঝে বেশ কিছু বছর রংতুলির ছোঁয়া থেকে একটু দূরেই ছিলেন। গণমাধ্যমে স্নাতক শেষ করে যুক্তরাজ্যের লা কর্ডন ব্লু প্রতিষ্ঠান থেকে পেসট্রির ওপর প্রশিক্ষণ নেন। দ্য ফ্লাওয়ারিস্ট নামে একটি বেকারি দোকানও আছে তাঁর। তবে এখন আঁকার ওপরই যেন বেশি ঝোঁক পেয়ে বসেছে। কাজ প্রসঙ্গে সারিয়া বলেন, ‘আমার কাজে পপ কালচার, বিজ্ঞাপন, সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো, মানুষের প্রতি আমাদের যে ধারণা বা উপলব্ধি তা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি।’ সারিয়ার কাজগুলো খুঁজে পাওয়া যাবে প্রিটি শিটি আর্টের অনলাইন পেজে। এ পর্যন্ত তিনটা একক প্রদর্শনী করেছেন। একটি যৌথভাবে। প্রতিষ্ঠানের নামটা কি একটু অদ্ভুত লাগছে? হেসে জানালেন, প্রথম দিকে করা কাজে রংগুলো দেখতে খুব সুন্দর লাগছিল, তাই প্রিটি। কাজের মধ্যে কিছুটা ভুলভালও ছিল, তাই শিটি। বর্তমানে ওয়ার্ল্ড লিডার এস বেবিস সিরিজ নিয়ে কাজ করছেন। বিভিন্ন দেশের নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিদের ভাবমূর্তি মজা করেই ক্যানভাসে আঁকছেন।

সারিয়ার আঁকার কোনো নির্দিষ্ট স্টাইল নেই। এটাই তাঁর স্টাইল। ২০১৪-এ প্রথম প্রদর্শনী করেন। ঢাকাতেই হয়েছিল। এই মুহূর্তে ‘মাই পেট প্রজেক্ট’ নামের ব্যানারের মাধ্যমে টাকা তুলছেন। কেউ চাইলেই তাদের পোষা প্রাণীটির ছবি আঁকিয়ে নিতে পারবেন সারিয়াকে দিয়ে। তাঁর বদলে সারিয়া ডোনেশন চাচ্ছেন। যেটা সরাসরি চলে যাবে ঢাকার বিভিন্ন প্রাণী আশ্রয়কেন্দ্রে। অক্টোবর থেকে কাজ শুরু করেছেন। এর মধ্যেই কিছু টাকা জমা করতে পেরেছেন।

ছবি আঁকার জন্য ব্যবহার করেছেন টোট ব্যাগ, ল্যাপটপ ব্যাগ, জুতা, টি-শার্ট, কোস্টার, পোস্টার, গ্রিটিং কার্ড ইত্যাদি। যেগুলো আগে কখনো ভাবেননি সেগুলোই এখন করছেন। প্রিন্ট মেকিং, কাঠ কেটে ব্লক তৈরি করেছেন। অনলাইন ও প্রদর্শনী এই দুই জায়গা থেকেই ক্রেতারা জিনিস কিনতে পারবেন। তবে কারও ফরমাশ অনুযায়ী কাজ করা হয় না প্রিটি শিটি আর্টে।

e4727fe87bb1f658e111783fae3d0f24-untitled-20অনিন্দ্যর ট্রাঙ্ক
বাবা চাইতেন মেয়ে মেডিকেলে পড়বে। ডাক্তার হবে। অনিন্দ্য ফয়সল খান সেই পথেই হেঁটেছেন। তবে মনটা কিন্তু রঙের কাছেই পড়ে থাকত। ছোটবেলায় দু বছর আঁকার প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন। বাবা তখন অনুমতি দিয়েছিলেন মেডিকেলে ছবি আঁকার প্রয়োজনেই। পড়াশোনার চাপে এর মধ্যে আর ওপথে যাওয়া হয়নি। বাড়িতেই টুকটাক জিনিসে রং করতেন। কখনো চাদরে, কখনো আবার ফতুয়ায়, কখনো পটারিতে। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির কাছ থেকে বেশ সহায়তা পেয়েছেন। এমবিবিএস সম্পূর্ণ করেছেন। বর্তমানে নিপসমে মাস্টার্স ইন পাবলিক হেলথ নিয়ে পড়ছেন। থিসিস করার মাঝে মাঝে একটু ফাঁক পেলেই আঁকতে বসে যান। শুক্রবারটা এই কাজ করেই কাটিয়ে দেন। পুরো সপ্তাহের পড়াশোনার জন্য শক্তি পেয়ে যান। মাধুবানী পেইন্টিং, মেক্সিকান ফোক আর্ট পছন্দ করেন। বেশির ভাগ কাজে সেটারই প্রভাব দেখতে পেলাম। ফেসবুকে ট্রাঙ্ক নামে একটি পেজের মাধ্যমে পণ্যগুলো বিক্রি করে থাকেন। তবে পড়াশোনার কারণে অনেক কাজ করা হয়ে ওঠে না।

এ বছর এপ্রিল থেকেই ট্রাঙ্কের যাত্রা শুরু। অনিন্দ্য ফয়সল খান ও লি শান্তা এর উদ্যোক্তা। অনিন্দ্য আঁকেন আর শান্তা নকশার দিকটি দেখেন। অনিন্দ্য বলেন, ‘আমাদের কাজগুলো সম্পূর্ণ হাতের এবং একটু ভিন্ন হওয়ায় দামটা হয়তো বেশি।’ ব্লাউজ, কুর্তা, ক্লিপ ফাইল ইত্যাদির ওপর কাজ করছে ট্রাঙ্ক।

সূত্র: প্রথম আলোfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment